‘ওয়াটার থিওরি’ অনুসরণ করেই কলকাতায় খুন হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের দেহাংশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, আলোচিত এই খুনের মামলার কলকাতাতে তদন্ত করতে আসা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ।
মাংসের টুকরো উদ্ধারের ক্ষেত্রে ‘ওয়াটার থিওরি’ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে হারুন বলেছেন, গ্রেপ্তার এক আসামি পানির শব্দ শুনতে পাওয়ার কথা বলেন। সে হিসেবে তাদের ধারণা হয়, মাংস লুকিয়ে ফেলতে ফ্ল্যাশ করার বিষয়টি। সেই পানির পথ ধরেই শেষ পর্যন্ত সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়েছে মাংসের টুকরা।
কলকাতায় খুন হয়ে যাওয়া এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে ইতোমধ্যেই এক নারীরসহ তিন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা। তাদের এক আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই ‘ওয়াটার থিওরি’ পাওয়া গেছে। এর অর্থ তিনি উপর থেকে পানির শব্দ শুনেছিলেন।
এরপর পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করেই পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডিকে অনুরোধ করে কমোড, সেপটিক ট্যাংক, সুয়ারেজ লাইন পরীক্ষা করা হয়। এরপরেই সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার করা হয় কয়েক কেজি মাংস।
ডিবি প্রধান হারুন বলেন, প্রাথমিকভাবে সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার মাংসের টুকরো এমপি আনারের মনে করা হলেও এ ব্যাপারে শতভাগ শতাংশ নিশ্চিত হতে ফরেনসিক এবং ডিএনএ টেস্ট জরুরি। পশ্চিমবঙ্গের সিআইডিকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে মাংসের টুকরো বাংলাদেশে নেওয়া হবে।
উদ্ধার করা মাংস এমপি আনারের লাশের টুকরো কিনা, তা পরীক্ষার জন্য ইতিমধ্যেই নমুনা পাঠানো হয়েছে সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে। প্রয়োজনে করা হবে ডিএনএ টেস্টও। সেক্ষেত্রে কলকাতায় ডাকা হতে পারে এমপি আনারের কন্যা ডরিনকে। পরীক্ষাগুলো দ্রুত করার অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা।
ডিএনএ টেস্ট করার জন্য এমপি আনারের কন্যা ডরিনা খুব শিগগিরই কলকাতা আসবেন। ভারতে আসার জন্য সম্ভবত তিনি ভিসাও পেয়ে গেছেন।’
গত বৃহস্পতিবার কলকাতায় আসে গোয়েন্দা প্রধানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। কলকাতা থেকে তারা যান নিউটাউন থানায়। এরপর তদন্ত কর্মকর্তাকে নিয়ে কৃষ্ণমাটি বাগজোলা খাল ঘুরে দেখেন। এরপর নিউটাউনের সঞ্জীবা আবাসন, সিআইডি ভবন, হাতিশাল খালসহ বিভিন্ন স্থানে যান। পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত গোয়েল, সিআইডি এডিজি রাজাশেখরনের সঙ্গে কথা বলেন হারুন।
একথা জানিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে কলকাতায় এবং বাংলাদেশে দুটি জায়গায় মামলা হয়েছে এবং সেই কারণেই তদন্ত করতে আমরা কলকাতায় এসেছি এবং সিআইডির প্রতিনিধি দলও তদন্তের স্বার্থে বাংলাদেশে গেছে। আমরা ইতিমধ্যে মূল ঘাতককে গ্রেফতার করেছি।
তিনি আরও বলেন, তারা অনেক কিছুই স্বীকার করেছে। কীভাবে তারা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিলো, বাংলাদেশের কোথায় কোথায় তারা বৈঠক করেছে, কলকাতায় এসে কোন কোন বাসায় ছিলো, তারা কি কি কাজ করেছিলো, এগুলো যাচাই বাছাই করার দরকার ছিল।
গোয়েন্দা প্রধান বলেন, বাংলাদেশের পেনাল কোডের ৩৬২, ৩৬৪ ধারা অনুযায়ী লাশ বা লাশের টুকরো, খুনির ঘড়ি বা অন্য কোন অংশ বিশেষ উদ্ধার না হলে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একটু সমস্যা হয়। আর সেই কারণে আমরা এসেছি। মূল কাজটি ছিল বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালানো, কলকাতায় যে আসামি গ্রেফতার হয়েছে তাকে নিয়েই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা, পাশাপাশি যে জায়গাগুলো তারা গিয়েছিল সেসব জায়গায় অভিযান চালানো। এমপি আনারের লাশ বা লাশের টুকরো যাতে পাওয়া যায় সেই কারণেই আসা।
তিনি আরও বলেন, একটা মামলার নিষ্পত্তি করতে গেলে যে সুরতহাল, মেডিক্যাল রিপোর্ট, ভিসেরা রিপোর্ট, আলামতের দরকার হয়। আমাদের কাজ ছিল আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য কলকাতা পুলিশকে শেয়ার করা এবং উনাদের কাজের সহযোগিতা করা। আমরা মনে করি, আমরা সহযোগিতা করতে পেরেছি এবং যে উদ্দেশ্যে এসেছিলাম যে একদিকে আলামত সংগ্রহ করা সিআইডিকে সহযোগিতা করা ডিজিটাল এভিডেন্স নিজে চোখে দেখা, কলকাতায় গ্রেপ্তার হওয়া জিহাদ হাওলাদার সাথে কথা বলে আমাদের দেশে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের বয়ান মিলিয়ে নেয়া। সব সেক্ষেত্রে আমরা ১০০ ভাগ সফল।
গোয়েন্দা দলের সদস্যরা যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে আখেরে অপরাধীদের শনাক্তকরণ, তাদের আটক বা অপরাধকে সংগঠিত না হওয়ার ক্ষেত্রে দু’দেশের পুলিশেরই লাভ। হারুন জানান, কলকাতা পুলিশের সাথে যে, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাতে আগামী কোন অপরাধী বাংলাদেশ থেকে অপরাধ করে কলকাতাকে আর ‘স্বর্গীয়’ ভবন মনে করত পারবে না। এর ফলে আরো দ্রুততার সাথে কলকাতা থেকে গ্রেফতার করতে পারবো।
গত ১৩ মে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনে শেষবার দেখা গিয়েছিলো এমপি আনারকে। মনে করা হচ্ছে ওই দিনই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে আততায়ীরা। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন এমপি আনারের বাল্যবন্ধু শাহীন। ইতোমধ্যেই গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি। নেপাল হয়ে দুবাই, তারপরে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে পারেন এই শাহীন। অন্যদিকে আরেক অভিযুক্ত সিয়াম বর্তমানে নেপালে অবস্থান করছে। তাদের উভয়কে ফিরে পেতে বাংলাদেশ সরকারের তরফে একাধিক পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে বলে জানান হারুন অর রশিদ।
তিনি বলেন, একজন আসামি কাঠমান্ডুতে রয়েছে, আরেকজন আমেরিকাতে রয়েছে। ইতিমধ্যেই কলকাতা পুলিশ কমিশনার, সিআইডি প্রধানের সাথে কথা হয়েছে। কাঠমান্ডুতে সিয়ামের অবস্থানের বিষয়টি সিআইডি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। নেপালকেও বাংলাদেশ সরকারের তরফে জানানো হয়েছে।
ডিবি প্রধান বলেন, আমাদের ধারণা এই কাণ্ডের মূল মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহীন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান করছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সিআইডি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। যেহেতু ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, যেহেতু তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা আছে তাই শাহিনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনতে তারা (ভারতীয় পুলিশ) যেন কথা বলে, সেই অনুরোধ করেছি।
তিনি আরও বলেন, আমরাও বাংলাদেশের পুলিশের আইজিপি’র সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছি। তাকে ফেরত পেতে ইন্টারপোলকে একটু চিঠি দিয়ে অবহিত করা হবে। আবার বাংলাদেশে যে আমেরিকান প্রবাসী আছে সেখানেও চিঠি দিয়ে অবগত করার পাশাপাশি সরাসরি গিয়ে কথা বলে শাহীনের বিষয়টি জানানো হবে।
হারুন জানান, কাঠমান্ডুতে সিয়ামের অবস্থানের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ইতিমধ্যে একটি চিঠি নেপালে পাঠানো হয়েছে এবং নেপালের সব সংস্থাকে অবগত করা হয়েছে যে, সিয়াম বর্তমানে নেপালে অবস্থান করছে। আমরা মনে করছি খুব শিগগিরই একটা ভালো খবর আসবে।
গত ১২ মে ভারতে এসে পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার কাছে বরানগরে দীর্ঘদিনের পরিচিত বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন এমপি আনার। আর পরদিন ১৩ তারিখ চিকিৎসা করাতে যাচ্ছেন বলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। সেই ঘটনায় ইতিমধ্যেই গোপাল জিজ্ঞাসাবাদ করেছে নিউ টাউন থানার পুলিশ ও সিআইডির কর্মকর্তারা। আপাতত পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে এই গোপাল বিশ্বাস। তার সাথেও কথা বলেছেন ডিবির গোয়েন্দা প্রতিনিধি দল।