উপকূলজুড়ে চলছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডব। সন্ধ্যা ছয়টার পর থেকে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করেছে দানবীয় এই ঘূর্ণিঝড়টি। এর আগে, বিকেল থেকেই রেমালের অগ্রভাগ উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করে। সাগর ফুঁসে উঠায় উচুঁ জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে সুন্দরবন। বিশেষ করে করমজল পর্যটন এলাকা ডুবে গেছে। ঘুর্ণিঝড়টি এখন পর্যন্ত দুইজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে বঙ্গোপসাগর উপকূলে আঘাত হেনেছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের ‘আই’ (চোখ) বা মূল কেন্দ্রটি। রোববার বাংলাদেশ সময় রাত আটটা নাগাদ এটি আঘাত হানে, যদিও সে সময় সাগরে ভাটা থাকায় তেমন বড় কোনও জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। মধ্যরাতের পরে পুরো ঝড়টি উপকূল অতিক্রম করবে বলে বলা হচ্ছে।
ঝূর্ণিঝড়ের গতিপথের বাংলাদেশের পায়রা ও মোংলা বন্দর সবচেয়ে কাছে ছিলো। রিমাল ওই এলাকাগুলো অতিক্রম করছে। এ সময় খুলনার কিছু এলাকায় প্রতি ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়টি পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসলে বৃষ্টি ঝরিয়ে এটি ধীরে ধীরে শক্তি হারাবে।
রোববার সন্ধ্যায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা জানান, ঘূর্ণিঝড়ের মূল অংশ বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে। পুরোপুরি অতিক্রম হতে রাত ৯ থেকে ১০টা বাজতে পারে। তিনি আরও বলেন, মূল অংশের পর এর পেছনের অংশ অতিক্রম করবে। এর প্রভাবে তীব্র বাতাস, জলোচ্ছ্বাস, ঝোড়ো হাওয়াসহ ভারী ও অতিভারী বৃষ্টি এবং বন্যা পরিস্থিতি তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কেন্দ্র আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে রাত দশটার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করবে। তবে সম্পূর্ণ ঘূর্ণিঝড়টি পরবর্তী পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টিসহ ঝোড়োহাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জলোচ্ছ্বাসে পানি বেড়ে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
১২০ কিলোমিটার বেগে উপকূলে আঘাত রিমালের
রোববার রাতে আবহাওয়াবিদ শামীম হাসান ভূইয়া এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে বাগেরহাটের মোংলার কাছ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-খেপুপাড়া উপকূলে আঘাত হেনেছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল। প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের কেন্দ্র মোংলার দক্ষিণপশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম শুরু করেছে। আরো উত্তরদিকে অগ্রসর হয়ে এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করে সম্পূর্ণ ঘূর্ণিঝড়টি পরবর্তী পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করতে পারে।
তিনি আরও জানান, ঝড়টির মূল অংশ যখন উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করে তখন নদী ও সাগরে ভাঁটা থাকার কারণে জলোচ্ছ্বাস কম হয়েছে। তবে, রাত পৌনে দশটার দিকে উপকূলীয় এলাকায় জোয়ার শুরু হবে। ঝড়ের শেষ ভাগটি যখন উপকূল অতিক্রম করবে, তখন সাগরে জোয়ার থাকার কারণে উপকূলীয় জেলাগুলোতে জলোচ্ছ্বাস বাড়বে। এজন্য উপকূলীয় এলাকায় মহাবিপদ সংকেত থাকবে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ছিল ৯০ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিলো। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সোমবার ঢাকাসহ সারা দেশে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ রোববার দুপুরেই উপকূল স্পর্শ করেছিলো। সন্ধ্যা ৬টার পর এর কেন্দ্রভাগ উপকূলে উঠে আসতে শুরু করে। মোংলা ও পায়রা বন্দরকে আগের মতোই ১০ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলোতকে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৮ থেকে ১২ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। সারাদেশে ভারী বর্ষণ হতে পারে। এতে পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধস হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’-এর নামকরণ করেছে ওমান। আরবিতে এর অর্থ বালি। এই নামে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে একটি শহরও রয়েছে।
জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে পুরো সুন্দরবন
আমাদের বাগেরহাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে রোববার রাতে সুন্দরবন উপকূলসহ বাগেরহাটের সবখানে বৃষ্টি হচ্ছে। সেসঙ্গে বেড়েছে পশুর নদীর পানি। মোংলায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত বহাল রয়েছে। রাতে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে পুরো সুন্দরবন। স্বাভাবিকের চেয়ে চার ফুট পানি বেড়ে সুন্দরবন তলিয়ে গেছে। পানির চাপ আরও বাড়বে। তবে বণ্যপ্রাণীর ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
মোংলায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে। রাতে তাদের জন্য খিচুড়ি ও শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সুন্দরবনের কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বন বিভাগের ঝুঁকিপূর্ণ ক্যাম্পগুলোতে থাকা বনরক্ষকীদের ইতোমধ্যে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে। মোংলা নদীতে যাত্রীবাহী ট্রলার চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কুয়াকাটায় মুষলধারে বৃষ্টি, সাগর উত্তাল
বিকেলে পর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সাথে দমকা হাওয়া বইছে। জোয়ারের কারণে জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সৈকত সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর বেশ উত্তাল। কুয়াকাটায় অবস্থানরত সব পর্যটক ও স্থানীয়দের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সব আবাসিক হোটেলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেওয়া হয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কন্ট্রোল রুম, মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ঝড়ে গাছ উপড়ে পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হলে দ্রুত গাছ অপসারণে আলাদাভাবে ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হবে। এছাড়া পর্যটন নগরী কুয়াকাটার সব আবাসিক হোটেলকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে।
থমথমে কক্সবাজার, পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক
কক্সবাজার থেকে আমাদের প্রতিবেদক কামরুল ইসলাম মিন্টু জানিয়েছে, রিমালের প্রভাবে সাগরের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে উপকূলে। রোববার দুপুরে জোয়ারে পানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় নিম্নাঞ্চলের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কক্সবাজারে বেড়াতে আসা পর্যটকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদেরকে সাগরে না নামতে নিষেধ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছু সংখ্যক পর্যটক কক্সবাজার ছেড়েছেন।
আগের দিন বিকালের পর থেকে কক্সবাজারে রিমালের প্রভাব শুরু হয়েছে। থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া বইছে। তবে কোথাও ঝোড়ো হাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। কিছু জায়গায় উপকূলের বাসিন্দারা ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কক্সবাজারে ৬৩৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। একইভাবে মহেশখালীতে মানুষদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার রয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানিয়েছেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় সিপিপির আট হাজার ৬০০ এবং রেড ক্রিসেন্টের দুই হাজার ২০০ জনসহ ১০ হাজার ৮০০ স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৬৩৮টি আশ্রয়কেন্দ্র। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। এ ছাড়া সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
আকাশ ও নদীপথ ভ্রমণ ব্যাহত
রিমালের ক্ষতি কমাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামাসহ সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে রোববার দুপুর ১২ থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকবে। ঝড়ের গতিবেগের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রিমালের প্রভাবে কক্সবাজার থেকে বিমান ওঠানামা বন্ধ ঘোষণা করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মর্তুজা বলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চালু করা হবে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে সারাদেশে লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, রোববার সকাল ৬টা থেকে সব ধরনের লঞ্চ এবং নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদী বন্দরগুলোকে ৪ নম্বর নৌ-মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।