বাংলাদেশ ব্যাংকের বারবার নীতি পরিবর্তনের কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম।
তিনি বলেন, একটা প্রকল্প করার সময় ব্যাংক ঋণের সুদহার, ডলার বিনিময় হারসহ নানাবিধ চিন্তাভাবনা করে তারপর কাজ শুরু করি; কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুদিন পরই যদি নীতিতে পরিবর্তন আনে, তখন ক্ষতিগ্রস্ত হই। অবশ্যই বারবার নীতি পরিবর্তন হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করেছি নীতিগুলো বারবার পরিবর্তন না করে যেন দীর্ঘমেয়াদি হয়। এতে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করতে সহজ হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার বিকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
প্রতিনিধি দলে ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, সিনিয়র সহ-সভাপতি আমীন হেলালী, পোশাক খাতের বিজিএমইএ সভাপতি এসএম মান্নান (কচি), টেক্সটাইল খাতের বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, নিটওয়্যার খাতের বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, মেট্রোপলিটন চেম্বারস অব কমার্সের সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছি। কথা হয়েছে ব্যাংক খাতের সার্বিক বিষয় নিয়ে। তবে আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার ও ডলার রেট। আমাদের জোরালো দাবি ছিল- ডলারের দর যে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা যেন আর না বাড়ে। গভর্নর আশ্বস্ত করেছেন ডলার রেট ১১৭ টাকা থেকে ১ টাকা কম বা বেশি হবে। এর বাইরে যাবে না।
মাহবুবুল আলম বলেন, ডলারের দাম একসঙ্গে ৭ টাকা বাড়ার কারণে যে পরিমাণ ঋণ বেড়েছে, সেই পরিমাণ টাকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণের আবেদন করেছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ ডলারের দাম বাড়ার কারণে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া যাদের ঋণে একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছে, তাদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানিয়েছেন গভর্নর। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ডলার মার্কেট স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, সুদহারের বিষয়ে গভর্নর বলেছেন এটা সম্পূর্ণ মার্কেটের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। বিভিন্ন ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড ৬ থেকে ৮ শতাংশ। তাই সুদ কোনোভাবেই ১৪ শতাংশের ওপরে যাওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো নীতি পরিবর্তন করার সময় অংশীজনদের (স্টেক হোল্ডারদের) সঙ্গে পরামর্শ করেননি। এটা করা উচিত। তাহলে এত সমস্যার সৃষ্টি হতো না।
তিনি বলেন, কোনো সৎ ব্যবসায়ী দেশের অর্থ বাইরে নিয়ে যায় না। কোনো সৎ ব্যবসায়ী তাদের রপ্তানির আয়ও দেশের বাইরে রেখে দেয় না। তবে এটা ঠিক, সব সেক্টরেই কিছু খারাপ লোক থাকতে পারে; কিন্তু এ উদাহরণ দিয়ে ওই সেক্টরকে মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। সুতরাং কেউ যদি এটা বলে থাকেন তিনি ভুল বলেছেন।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক অনুষ্ঠানিকভাবে একক গ্রাহক ঋণসীমা ২৫ শতাংশ করেছে। অপরদিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকগুলোকে বলেছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি যেন ঋণ সীমা না যায়। এ বিষয়ে গভর্নর আশ্বাস দিয়েছেন, এখন থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবে ব্যবসায়ীরা। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছি, সুদ হার যাতে আর না বাড়ে। কারণ সুদ হার বাড়লে খেলাপি ঋণও বাড়বে। আর মুদ্রার বিনিময় হার উঠানামার কারণে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এই ক্ষতি থেকে বের হওয়ার জন্য যাতে একটি রোডম্যাপ তৈরি করে, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার দিয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিনিয়োগ অঞ্চল ছাড়া কোথাও ব্যাংকগুলো বড় বিনিয়োগ করতে পারবে না। আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করে এবং আমাদের না জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের সার্কুলার দিয়েছে। এরই মধ্যে অনেকেই শত শত কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছেন। তাই এ বিষয়টি বিবেচনা করে এই সার্কুলার প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেছি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডলারের অভাবে এলসি খুলতে পারছি না। এদিকে ইডিএফ কমিয়ে তিন বিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিকল্প একটি তহবিল ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এখন ব্যবসায়ীরা ১১৭ টাকায় এলসি খুলতে পারছেন কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যদি কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করতে বলা হয়েছে। তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, গত ৮ মে ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতি সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট (স্মার্ট) প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। ঋণের সুদহার সম্পূর্ণরূপে বাজারভিত্তিক করার জন্য ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় সুদভিত্তিক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়; কিন্তু এখন এ নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পিছু হটছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ধারণা করা হচ্ছে, আইএমএফের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি।
এদিকে বুধবার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, যেসব গ্রাহকের নির্ধারিত একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছিল, তাদের ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণ নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এরপরও কিছু গ্রাহক একক গ্রাহক ঋণের ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করার জন্য আবেদন করছেন, যা নির্দেশনার পরিপন্থি। এমন প্রেক্ষাপটে বৃহৎ ঋণঝুঁকি হ্রাস, করপোরেট সুশাসন সমুন্নত রাখা এবং ঋণ বিতরণে উত্তম চর্চা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য একক গ্রাহক ঋণসীমা কোনোক্রমেই অতিক্রম না করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া যাচ্ছে।