সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র চলছিল। কথা ছিল—হবে জুডিশিয়াল ক্যু। আর এই ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত। এই জুডিশিয়াল ক্যুয়ের পরিকল্পনার তথ্য পেয়ে যান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা। তাদের দেওয়া তথ্য পেয়ে ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে আইন উপদেষ্টা গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরবর্তী (প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ) প্রক্রিয়াটা হচ্ছে আইন উপদেষ্টা হিসেবে আমার স্বাক্ষরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দপ্তরে যাবে। তিনি এখন রংপুর বা সম্ভবত বিমানে আছেন, তিনি নামার পর তার সম্মতি সাপেক্ষে এটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। রাষ্ট্রপতি এটা গ্রহণ করলে কার্যকর হবে। এরপর নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
কে হচ্ছেন নতুন প্রধান বিচারপতি— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা আমরা বলব না, তবে একটা জিনিস বলব, প্রধান উপদেষ্টার মতামত গ্রহণ করব। কনসার্ন যারা আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলব। আমার মন্ত্রণালয় থেকে যদি এ বিষয়ে কোনো ভূমিকা রাখার থাকে, চেষ্টা করব সবচেয়ে যোগ্য, সৎ এবং নিরপেক্ষ একজন মানুষকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় ড. আসিফ নজরুল বলেন, প্রিয় দেশবাসী, আপনাদের সঙ্গে একটি বিশেষ সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে শেয়ার করার প্রয়োজন অনুভব করছি। আমাদের প্রধান বিচারপতি কিছুক্ষণ আগে পদত্যাগ করেছেন। ওনার পদত্যাগপত্র এরই মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে এসে পৌঁছেছে। এটা উপযুক্ত প্রসেসিংয়ের জন্য আমরা কালবিলম্ব না করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেব এবং আশা করব এটা খুব দ্রুত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। আপনাদের জন্য আমি আরও জানাচ্ছি আমরা শুধু প্রধান বিচারপতির পদত্যাগপত্রই পেয়েছি। অন্যদের ব্যাপারে কোনো আপডেট নেই। আপনারা সবাই শান্ত থাকবেন। দেশের সম্পদ নষ্ট করবেন না। সবাই শান্ত থাকবেন, ধন্যবাদ।
এর আগে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের গতকাল দুপুর ১টার মধ্যে পদত্যাগের আলটিমেটাম দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন। বেলা ১১টায় হাইকোর্ট চত্বরে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এ আল্টিমেটাম দেন। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের বিচারপতিদের ফুলকোর্ট সভা ডাকা এবং পরে স্থগিত করার প্রতিক্রিয়ায় কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সমন্বয়করা।
হাসনাত আবদুল্লাহ তখন বলেন, দুপুর ১টার মধ্যে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিরা পদত্যাগ না করলে তার পরিণতি হবে শেখ হাসিনার মতো। আমরা প্রধান বিচারপতিসহ দলবাজ বিচারপতিদের বাসভবন ঘেরাও করে পদত্যাগে বাধ্য করব। দলবাজ বিচারপতিদের সরিয়ে দেয়ার মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদের মূল উৎপাটন করা হবে। হাসনাত আব্দুল্লাহ আরও বলেন, জুডিসিয়ারি ক্যু করার পাঁয়তারা চলছে, অবশ্যই প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে হবে। এদিকে প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্যদের পদত্যাগের দাবিতে হাইকোর্ট অঙ্গনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ঢল নেমেছে। বেলা ১১টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে হাইকোর্টে আসা শুরু করে। সকাল ১০টা ২০ মিনিট থেকে সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের সামনে থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভে শতাধিক আইনজীবী অংশগ্রহণ করেন। বিক্ষোভ মিছিলটি সুপ্রিম কোর্টের মূলভবনসহ আপিল বিভাগের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করেন। এর আগে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ে ফুল কোর্ট সভা ডেকে আবার স্থগিত করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
গতকাল শনিবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভা হচ্ছে না আজ। অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গতকাল সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়ে প্রধান বিচারপতির এ সভা ডাকার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, ‘ফ্যাসিবাদের মদতপুষ্ট ও নানা অপকর্মে জড়িত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সরকারের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করে ফুল কোর্ট মিটিং ডেকেছেন। পরাজিত শক্তির যে কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না। আইনজীবীরা এরই মধ্যে এর প্রতিবাদে জড়ো হয়েছেন। আমরা আগেই প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলাম। ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের উস্কানি দিলে এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে। অবিলম্বে বিনা শর্তে প্রধান বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করুন এবং ফুল কোর্ট মিটিং বন্ধ করুন।’
পদত্যাগ করলেন পাঁচ বিচারপতি : সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় আইন মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন তারা। আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
পদত্যাগকারী পাঁচ বিচারপতি হলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন। এর আগে গতকাল পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, সুপ্রিম কোর্ট বিল্ডিং ও রেকর্ডসমূহ রক্ষা করা এবং বিচারপতিদের শারীরিক হেনস্তা থেকে রক্ষা করতে তিনি পদত্যাগ করেছেন। তিনি আরও বলেন, ?‘কোর্ট প্রাঙ্গণ রক্ষা, বিচারপতিদের বাড়ি-ঘর, জাজেজ টাওয়ার রক্ষা এবং জেলা জজ কোর্টগুলো রক্ষার স্বার্থে আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
উল্লেখ্য, গতকাল সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্যদের পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেন। পরে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হতে থাকেন। সেখানে তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দেয়া শুরু করেন। এরপর থেকেই একে একে পদত্যাগ করতে থাকেন প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিরা।