সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

ঢাকা ওয়াসার চার প্রকল্প লোপাট ৩০০০ কোটি টাকা

সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসার চার প্রকল্পেই ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে সংস্থাটির স্তরে স্তরে অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসবের তথ্য পেয়ে রীতিমতো বিস্ময়ে হতবাক সংশ্লিষ্টরা। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকার পরও সংস্থার শীর্ষপদে নিয়োগ পান ‘বিতর্কিত’ ও দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী তাকসিম এ খান। এরপর তিনি প্রতিষ্ঠানের অর্গানোগ্রামের বাইরে গিয়ে পরিচালক পদে নিয়োগ দেন দুজনকে। অবৈধভাবে এ দুজনসহ পাঁচ কর্মকর্তার নিয়োগ এবং তিন কর্মকর্তার নিয়মবহির্ভূত পদোন্নতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্যের তথ্যও এসেছে দুদকের হাতে। এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম ওয়াসায় দুর্নীতির রেকর্ডপত্র সংগ্রহের কাজ করছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ঢাকা ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘দুর্নীতি নেই বাংলাদেশে এমন কোনো সংস্থা আছে কি না, সেটা আমার জানা নেই। সে হিসাবে ঢাকা ওয়াসায়ও দুর্নীতি রয়েছে। তবে এখানে কে কীভাবে এবং কোন কাজের ক্ষেত্রে দুর্নীতি করেছে, সেটা বলা যায় না। আর দুর্নীতি হলে সেটা ঢাকা ওয়াসা প্রশাসনের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে থাকবে; এখানে বোর্ডের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এ কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সহযোগিতা করার মতোও তেমন কোনো ব্যাপার নেই। ঢাকা ওয়াসা বোর্ড কর্মচারী সমবায় সমিতির ১৩২ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে। এক্ষেত্রে আর্থিক কোনো অনিয়ম পেলে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে অবহিত করা হবে।’

চাইলে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ওয়াসায় দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অনুসন্ধান কর্মকর্তা তথ্য ও রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করছেন। প্রাপ্ত তথ্যের বিস্তারিত পর্যালোচনা শেষে অভিযোগসংশ্লিষ্ট বিষয় প্রমাণিত হলে মামলা করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাথমিকভাবে দুদকের হাতে যেসব তথ্য এসেছে তাতেই দেখা গেছে, ওয়াসার প্রকল্প বাস্তবায়নে ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে। অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি বিবেচনা না করে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ফলে বিদেশি ঋণনির্ভর এসব প্রকল্প থেকে ঋণ পরিশোধের সমপরিমাণ অর্থ আয় হচ্ছে না। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের দাম বাড়িয়ে যার দায় চাপানো হচ্ছে নগরবাসীর ঘাড়ে।

জানা যায়, রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা মেটাতে পদ্মা যশলদিয়া প্রকল্পর অধীনে পদ্মা নদীর পানি আনার উদ্যোগ নেয় ঢাকা ওয়াসা। মুন্সীগঞ্জের পদ্মপারের যশলদিয়া পয়েন্টে ৩ হাজার ৬৭০ কোটি ৪৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রাথমিক তথ্যে দুদক জানতে পেরেছে, এই প্রকল্পে লোপাট করা হয়েছে অন্তত ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। লুটপাটের কারণে পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার কথা। বাস্তবে পাওয়া যাচ্ছে ২০ থেকে ২৫ কোটি লিটার পানি, যা সক্ষমতার অর্ধেক। এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সরবরাহ লাইনের কথা চিন্তা করা হয়নি বলেই এ অবস্থা বলে জানা গেছে। অথচ ৪৫ কোটি লিটার পানি পাওয়ার জন্য ওই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট পরিচালনায় যে পরিমাণ খরচ হতো, এখন অর্ধেক পানি পেলেও খরচ হচ্ছে প্রায় একই।

দুদকের পাওয়া তথ্যে ওয়াসার লুটপাটের আরেক প্রকল্প দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার। রাজধানীবাসীর পয়ঃবর্জ্য সেবা দেওয়ার জন্য ঢাকার দাশেরকান্দি এলাকায় একটি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে ঢাকা ওয়াসা। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৭১২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। দুদকের পাওয়া প্রাথমিক তথ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়নেও লোপাট হয়েছে ১ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ হলেও স্যুয়ারেজ সংগ্রহের কোনো পাইপলাইন স্থাপন করা হয়নি। নতুন করে পয়ঃবর্জ্য সংগ্রহের পাইপলাইন না করা পর্যন্ত এই প্রকল্প থেকে রাজস্ব আয় হবে না। আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে এই প্রকল্প থেকে কাক্সিক্ষত রাজস্ব আয় দুরূহ হবে। এছাড়াও গন্ধববপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, গুলশান-বারিধারা প্রকল্পে ৫০ কোটি টাকা এবং সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার ফেজ-২-এর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ১৫ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য পেয়েছে দুদক। এ হিসাবে ওয়াসার বাস্তবায়িত চারটি প্রকল্পেই লোপাট হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।

জানা যায়, প্রকল্পের টাকা লুটপাটের বাইরেও ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির অর্থ আত্মসাতের তথ্যও পেয়েছে দুদক। অর্থ লোপাটের জন্য সমবায় সমিতির সদস্য নয়-এমন লোকদের নিয়ে ২০১৯ সালের ৩০ মে গঠিত হয় কমিটি। এই কমিটির মাধ্যমে সমিতির ঠিকাদারি বিল বাবদ ৪১ কোটি ৭০ লাখ ৮০ হাজার ৭৫০ টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়। এছাড়া সমিতির মালিকানার ৬২ হাজার ৪৮১ পিস পানির মিটার সমিতির অনুমোদন ব্যতিরেকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩৫ কোটি টাকা।

দুদকের হাতে আসা সমবায় অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা থেকে কমিশন বাবদ প্রায় ১৩৪ কোটি টাকা সমিতির ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে। অথচ সমিতির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে জমা দেখানো হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। বাকি প্রায় ১৩২ কোটি টাকার কোনো হিসাব নিরীক্ষা দল পায়নি। আর ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে সমিতির ব্যাংক হিসাব থেকে ৪৪ কোটি ২১ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। এই টাকা ব্যয়ের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির বিপুল আয়ের উৎস গ্রাহকের বিল থেকে পাওয়া কমিশন। ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই সমিতি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঢাকা ওয়াসার সাতটি রাজস্ব অঞ্চলে গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায়ের কাজ করে। এর বিপরীতে কর্মচারী সমিতি মোট বিলের ১০ শতাংশ কমিশন হিসাবে পেয়েছে।

নিয়োগ বাণিজ্য : ২০২০ সালে ওয়াসার অর্গানোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত নয়-এমন দুটি পরিচালক পদে মো. আবুল কাশেম ও একেএম সহিদ উদ্দিনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়াও অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ঢাকা ওয়াসার কো-অর্ডিনেশন অফিসার শেখ এনায়েত আব্দুল্লাহ, সহকারী সচিব মৌসুমী খানম ও ডেপুটি চিফ ফাইন্যান্স অফিসার রত্নদ্বীপ বর্মণকে। আর প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামান ও কো-অর্ডিনেশন অফিসার শেখ এনায়েত আব্দুল্লাহকে নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এসব কাজের মাধ্যমে ওয়াসা এমডি তাকসিম এ খান আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছে দুদক।

অস্বচ্ছ নিয়োগ ও প্রভাব খাটিয়ে মেয়াদ বৃদ্ধি : দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ঢাকা ওয়াসা বোর্ড। সেখানে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কাজের ২০ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তপূরণে ব্যর্থ হলেও ঢাকা ওয়াসা বোর্ড প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে নিয়োগ দেয়। ওই সময়ে ঢাকা ওয়াসার বর্তমান এমডির এসব কাজের কোনো যোগ্যতা ছিল না। নিয়োগ প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠায় সেসময় স্থানীয় সরকার বিভাগ ঢাকা ওয়াসা বোর্ডকে ভবিষ্যতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকালে পরীক্ষা ও নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়।

আবেদন না করেও চাকরি : প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মানবসম্মদ ও প্রশাসন পদে আবেদন না করেও নিয়োগ পেয়েছেন ড. সৈয়দ মো. গোলাম ইয়াজদানী। বিপরীতে ৪৩ জন প্রার্থী নিয়ম মেনে আবেদন করেও চাকরি পাননি। এ ঘটনাকে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের প্রচলিত রীতি ও আইনের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের নগ্ন দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, ঢাকা ওয়াসা বোর্ড গত ৯ জানুয়ারি এই পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে নির্ধারিত লিঙ্কে আবেদন করতে বলা হয়। ওই নির্দেশনা অনুসরণ করে ৪৩ জন ব্যক্তি আবেদন করেন। তাদের কাউকে চাকরি না দিয়ে বোর্ডের সুপারিশক্রমে ড. সৈয়দ মো. গোলাম ইয়াজদানীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২৪ মার্চ এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সুপারিশের আলোকে ড. সৈয়দ মো. গোলাম ইয়াজদানীকে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (মানবসম্পদ ও প্রশাসন) পদে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৯৬-এর ২৯(১) ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিয়োগের প্রস্তাব সরকারের অনুমোদন নির্দেশক্রমে জ্ঞাপন করা হলো।

দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী একেএম সহিদ উদ্দিন বলেন, ঢাকা ওয়াসার প্রকল্পগুলোয় দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। কেননা দাতা সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন করা হয়। এখানে দাতা সংস্থার নিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করা হয়। ঢাকা ওয়াসা শুধু প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকে। এর আগে একটি প্রকল্পের অনিয়ম তদন্তে নেমে কোনো দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি ঢাকা ওয়াসা।

Facebook
X
WhatsApp
Email
Telegram
সর্বশেষ
ফেসবুক নেটওয়ার্ক ও পার্টনার পেজ
মিডিয়া
Cover for Table Talk Uk
595,824
Table Talk Uk

Table Talk Uk

Table Talk UK Discusses the political and social issues of the country. Our only purpose is to expose social inconsistencies and politics in the face of accountability on the path to democracy and talk about the rights of people.

This message is only visible to admins.
Problem displaying Facebook posts. Backup cache in use.
PPCA Error: Due to Facebook API changes it is no longer possible to display a feed from a Facebook Page you are not an admin of. The Facebook feed below is not using a valid Access Token for this Facebook page and so has stopped updating.

Smash Balloon Custom Facebook Feed WordPress Plugin The Custom Facebook Feed plugin

সর্বশেষ সংবাদ জানতে—এখনই সাবস্ক্রাইব করুন!
সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
কপিরাইট © 2025 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত — লন্ডন মিরর।
সম্পাদক: হাসিনা আক্তার
সার্চ করুন
লগইন/সাইন আপ
সর্বশেষ সংবাদ জানতে—এখনই সাবস্ক্রাইব করুন!