সেনাপ্রধান থেকে দেশের রাষ্ট্রপতি হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রাষ্ট্রপ্রধানের পদে থেকে নিজ হাতে গড়েন জাতীয় পার্টি (জাপা)। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারিতে। আশির দশকের শেষ দিকে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে রীতিমতো টেক্কাও দিয়েছে এ দলটি। তবে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদের পতনে ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে। কেউ যান বিএনপিতে, কারও ঠাঁই হয় আওয়ামী লীগে। একপর্যায়ে জাপা ভেঙে হয় চার ভাগ। তবে রাজনীতির মাঠে বরাবরই দাপট দেখিয়েছে এরশাদের নেতৃত্বাধীন মূল জাপাই।
১৯৯১, ৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংসদীয় আসনে জয়ের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে ছিল জাপা। ২০০৮ সালে দলটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোট সরকার গঠন করে। আর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় জাপা। ২০১৯ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা যান। দলের হাল ধরেন তার ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের। পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হন রওশন এরশাদ। জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতাও হন এরশাদপত্নী।
এমন পরিস্থিতিতে দলের বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ শীর্ষ নেতারা গত দুই বছর ধরে বলে আসছেন, প্রতিষ্ঠার পর বর্তমানে সবচেয়ে সুসংগঠিত অবস্থায় দল চালাচ্ছে জাতীয় পার্টি। আগামীতে কারও সঙ্গে জোট নয়, তারা ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে চান। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে আবারও ভাঙনের মুখে জাপা। এবার ভাঙনের শুরু রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে বসানোর চেষ্টা থেকে।
এ ইস্যুতে প্রকাশ্যে মন্তব্য করায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর মসিউর রহমান রাঙ্গাকে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে তাকে অব্যাহতি দেন। সেই আদেশ এরই মধ্যে কার্যকরও হয়েছে। অথচ রাঙ্গা বর্তমানে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ। তিনি দলটির সাবেক মহাসচিব ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি
ফলে রাঙ্গার অব্যাহতি ঘিরে চলছে দুই পক্ষের কথা চালাচালি। বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছেন পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও অব্যাহতি পাওয়া রাঙ্গা। জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত রংপুরেও এ নিয়ে সরগরম রাজনীতির মাঠ। সবমিলিয়ে জাতীয় পার্টিতে সংকট আরও ঘনীভূত।
দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর অভিযোগ, সংগঠনবিরোধী কার্যক্রমের কারণে রাঙ্গাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন ধরে তিনি জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন ফোরামে দলের স্বার্থবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে দু-তিন মাস আগেও রাঙ্গা দল থেকে অব্যাহতির কথা চিন্তা করেছিলেন পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তবে সেসময় ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যান রাঙ্গা।
মসিউর রহমান রাঙ্গা বলছেন, রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা করতে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তার প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না। তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে এমন বক্তব্য দেওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় পার্টির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিরোধী দলীয় নেতার পদ থেকে রওশন এরশাদকে সরানোর ইস্যুতে মসিউর রহমান রাঙ্গা যে প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমে দিয়েছেন, তা মোটেও পছন্দ হয়নি জিএম কাদেরের। শ্রমিক নেতা ও সরকারের আস্থাভাজন হয়ে রাঙ্গা বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করেন। এজন্য পার্টির অনেক শীর্ষ নেতাও তার ওপর ক্ষুব্ধ। সেসব নেতারা পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের কানভারী করে রাঙ্গাকে অব্যাহতি দিতে প্ররোচিত করে থাকতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এমনটা হতে পারে তেমন কিছুই টের পাইনি। ওনার (জিএম কাদেরের) বয়স হয়ে গেছে। হয়তো ওনি মনে করছেন, যেকোনো সময় তিনি সিক (অসুস্থ) হয়ে যেতে পারেন। ওই কারণে মনে করতে পারেন, চেয়ারম্যানটা রাঙ্গাই হয়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক ভালো তো। এটা ওনি ভয় পায়। পার্লামেন্টে ওনি (জিএম কাদের) আমাকে দেখেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছি। তখন ওনি ভয় পান। মনে করেন, আমি মনে হয় চেয়ারম্যান পদ নিয়ে নিচ্ছি। এটাই প্রধান কারণ। অন্য কিছু দেখি না।’
রাঙ্গার এমন বক্তব্যের সত্যতা ফুটে উঠেছে জিএম কাদেরের দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যেও। তিনি সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে- এমন নেতাদের একাধিকবার হুঁশিয়ার করেছেন। এমনকি সরকারের দালালি করলে দলত্যাগ করতে হবে বলেও দলের একাধিক ফোরামে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন। সরকারের সঙ্গে মসিউর রহমান রাঙ্গার ঘনিষ্ঠতায় জিএম কাদের যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাতে দলের অনেকেই একমত।
এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘জাপা চেয়ারম্যান দলের রাজনীতির বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। জি এম কাদের ও আমি বলেছি, জাতীয় পার্টি কারও দালাল না। দালালি করবেও না। কারও পকেটের লোক না। জাতীয় পার্টির নিজস্ব অস্তিত্ব আছে, ঐতিহ্য আছে।’