বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের কয়েক ডজন ব্যক্তির ওপর নতুন করে স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, তবে এই তালিকায় বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি নেই।
মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণার ৭৫ বর্ষপূর্তি সামনে রেখে শুক্রবার নতুন ঘোষণার কথা জানিয়েছে মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিকেন বলেছেন, মানবাধিকার রক্ষায় বিশ্বব্যাপী অঙ্গীকারের কথা বিবেচনায় রেখেইিএই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
আর এবার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় (ডিপার্টমেন্ট অব দ্য ট্রেজারি) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (স্টেট ডিপার্টমেন্ট) সম্মিলিতভাবে স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের দুদিন আগে ১৩ দেশের ৩৭ জন পদাধিকার ব্যক্তিকে স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে।
নতুন মার্কিন স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় যে ১৩ দেশ পড়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- চীন, রাশিয়া, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, আফগানিস্তান, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো, হাইতি, লাইবেরিয়া, দক্ষিণ সুদান ও সুদান, সিরিয়া, উগান্ডা ও জিম্বাবুয়ে।
এদের মধ্যে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্যাংশনের আওতায় পড়েছে ৯ দেশের ২০ ব্যক্তি। এই দেশগুলো হচ্ছে- আফগানিস্তান, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো, হাইতি, ইরান, লাইবেরিয়া, চীন, দক্ষিণ সুদান ও উগান্ডা।
বিএনপি ও জামায়াত-পন্থীরা প্রচারণা চালিয়ে আসছিলো যে, ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ঘিরে বাংলাদেশের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসছে। কিন্তু স্যাংশন ও নিষেধাজ্ঞার তালিকা সামনে আসার পর দেখা গেছে, সেখানে বাংলাদেশের কারো নাম নেই।
আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর কয়েকদিন আগে আমেরিকার স্যাংশন ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা চলছে যে, নতুন ঘোষণা ভোটমুখী বাংলাদেশকে স্বস্তি দিয়েছে।
আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞোকে হাতিয়ার বানিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে বিএনপি-জামায়াত জোট।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নির্বাচনকে উৎসাহিত করতে গত মে মাসে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে মার্কিন প্রশাসন। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টিকারীরা ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে বলে জানায় যুক্তরাষ্ট্র। সরকারের পাশাপাশি বিরোধীদের কেউ যদি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়, তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে বলে নতুন ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে।
কিন্তু আসন্ন ভোট বর্জন করে সহিংস আন্দোলনে চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট। তাদের আশা ছিলো, বিশ্ব মানবাধিকার দিবসকে সামনে ঘিরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিয়ে সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলে ক্ষমতার পালাবদল ঘটিয়ে ফেলবে। কিন্তু সে আশা পূরণ না হওয়ায় কার্যত হতাশ বিএনপি-জামায়াতের নেতা, সমর্থক ও কর্মীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, স্যাংশনের আওতায় পড়া ব্যক্তিদের যুক্তরাজ্য ও কানাডা প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়। এসব ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সম্পদ ভোগদখল করতে পারবেন না এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যাংকে থাকা অর্থ তুলতে পারবেন না।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে কোনো ধরণের ব্যবসা ও লেনদেনও করতে পারবেন না স্যাংশন ও নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তিরা।
যেসব কারণে স্যাংশন
নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং মার্কিন অর্থব্যবস্থাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের থেকে নিরাপদ রাখার প্রতিশ্রুতি পূরণে যুক্তরাষ্ট্র কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ, তা এই নিষেধাজ্ঞায় প্রতিফলিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় (ডিপার্টমেন্ট অব দ্য ট্রেজারি) বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসী সংগঠন, অপরাধমূলক কার্যকলাপ, এলজিবিটিকিউ প্লাস ব্যক্তিদের দমন, আন্তর্জাতিকভাবে দমন-পীড়ন, পরিবেশগত অপরাধ ও অবক্ষয়ের সাথে যুক্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে লক্ষ্য করে এ স্যাংশন আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
সাংবাদিক, সুশীল সমাজের সদস্য ও অন্যায়ের প্রতিবাদকারীদের দমন-পীড়নসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপব্যবহার কারীদের বিরুদ্ধেও থাকবে এই নিষেধাজ্ঞা।
এছাড়া বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, নির্বিচার আটক, অপহরণ, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও যৌন যৌন সহিংসতার ঘটনায় জড়িতরাও থাকবে নিষেধাজ্ঞার আওতায়।
মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপব্যবহার কারীদের জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র।
স্যাংশনের আওতায় যারা
স্যাংশনের তালিকায় রয়েছেন ইরানের শীর্ষ দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। এরা হলেন- মাজিদ দাস্তজানি ও মোহাম্মদ মাহদি খানপুর আরদেস্তানি। এ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত জেনারেল কাসেম সোলায়মানি হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মার্কিন ঘাঁটিতে নজরদারি ও হামলার পরিকল্পনা করছিলেন।
আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন কট্টর ইসলামপন্থী তালেবান গোষ্ঠীর বেশ কয়েক জন নেতা রয়েছেন স্যাংশনের তালিকায়। মূলত নারী, তরুণী ও কিশোরীদের দমন পীড়নের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তালেবান নেতাদের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, তারা হত্যা, অপহরণ, বেত্রাঘাত ও মারধোরে জড়িত।
স্যাংশন ও নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন চীনের নিরাপত্তা বাহিনীর দুই কর্মকর্তা। এরা হলেন- গাও কি ও হু লিয়ান হে। এরা দুজনই চিনের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ জিনজিয়াংয়ের সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যম সারির কর্মকর্তা। প্রদেশটির সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতন নিপীড়নের অভিযোগে তাদের ওপর স্যাংশন দিয়েছে মার্কিন সরকার।
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে চলমান অস্থিরতার জন্য দেশটির দুই ব্যক্তিকে দায়ী করে স্যাংশনের আওতায় আনা হয়েছে। এরা হলে জিন-ফ্রান্সিস বোজিজ (বোজিজ) ও মহামত সালেহের (সালেহ)।
এছাড়া যৌন সহিংসতা, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসী সংগঠনকেন্দ্রিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কঙ্গোর পাঁচজন, হত্যা ও মাদক সহিংসতার দায়ে হাইতির চারজন, লাইবেরিয়ায় একজন এবং নিয়মতান্ত্রিক ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের দক্ষিণ সুদানে তিনজনের ওপর স্যাংশন আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।