তিন দশক আগে বাবার সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন তিনি। ১৯৯৬-৯৭ সালেও তার আয় প্রায় শূন্যই ছিল। ছিল না নিজস্ব এক টুকরা জমি। এখন তার বিঘা বিঘা জমি, শতকোটি টাকা।
চমক দেখানো এই ব্যক্তির নাম রমজান আলী। টানা দেড় যুগ ধরে রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সভাপতি পদে রয়েছেন তিনি। ১৯৯৭ সালে মহানগর যুবলীগের সহসভাপতি হওয়ার পর বদলাতে থাকে তার জীবনের চিত্র। ২০০৪ সালে মহানগর যুবলীগের সভাপতি হলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া রমজান আলী সেই থেকে এ পর্যন্ত (২০২২) সভাপতি পদেই বহাল রয়েছেন। যদিও তার বয়স এখন ৬০ বছরের কাছাকাছি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, পশ্চিমাঞ্চল রেলের সব ধরনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন রমজান আলী। নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিয়ে রেলওয়ে স্টেশন ভবনের ওপর গড়ে তুলেছেন আবাসিক হোটেল ‘সিটি প্লাস’। অনেক জমি ও প্লটের মালিক হয়েছেন। স্ত্রী, তিনপুত্রের নামেও গড়েছেন প্রচুর সম্পদ। তবে তিনি আয়কর দেন মাত্র পৌনে দুই কোটি টাকার সম্পদের।
রমজান আলী ২০২০-২১ কর বছরে মোট সম্পদ দেখিয়েছেন ১ কোটি ৮৮ লাখ ২৮ হাজার টাকা। পরিবারের জন্য এই এক বছরে ব্যয় দেখিয়েছেন ৯ লাখ ৪২ হাজার ৬০০ টাকা। তার আগের বছর রমজান আলীর সম্পদ ছিল এক কোটি ৬৭ লাখ ৯১ হাজার ১১৯ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে রমজান আলীর সম্পদ বেড়েছে ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৪০০ টাকা। ২০২১-২২ কর বছরে আয় ব্যয়ের হিসাব এখনও দাখিল করেননি তিনি।
রমজান আলীর প্রদর্শিত সম্পদের মধ্যে রয়েছে সপুরার শুকনাদীঘি কেনায় ৫৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৭ টাকা ক্রয়মূল্যের ২ দশমিক ৯৩১৯ একর জমির ছয় ভাগের এক ভাগ, ৯টি দোকানঘরে ২১ লাখ ২৫ হাজার ২৮২ টাকার বিনিয়োগ, ৮ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ টাকার আরেকটি জমি, ২৮ লাখ টাকায় শিরোইল মৌজায় ০.০৫১৮ একর জমিসহ একতলা বাড়ি, ৩০ হাজার টাকার ও ১৩ হাজার টাকা ০.০১৫৫ একর পরিমাণের দুটি গৃহসম্পত্তি। বাস্তবে এসব সম্পত্তির দাম অন্তত তিনগুণ বেশি। এ ছাড়া দেড় লাখ টাকা ক্রয় মূল্যের অলংকার, এক লাখ টাকা ক্রয়মূল্যের আসবাবপত্র এবং ৮০ হাজার টাকার বৈদ্যুতিক সামগ্রী দেখিয়েছেন।
একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, রমজান আলীর প্রদর্শিত আয় ১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা দেখালেও বাস্তবে তার সম্পদ অন্তত ১০০ কোটি টাকা।
আরডিএর ভবন দখল: শিরোইলে ঢাকা বাস টার্মিনালে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) একটি দুইতলা ভবনের ওপর তলা ইজারা নিয়েছেন রমজান আলী। সেই দুইতলা ভবনটি এখন চারতলা। রমজান আলী অবৈধভাবে তিন ও চারতলা নির্মাণ করে ভোগদখলে রেখেছেন। রমজানের ছেলে তৃতীয় তলায় গার্মেন্ট কারখানা করেছেন।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এস্টেট অফিসার বদরুজ্জামান বলেন, ‘রমজান আলীকে শুধু দুইতলা ইজারা দেওয়া হয়েছে। তিনি অবৈধভাবে তিন ও চারতলা করেছেন। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য রমজান আলীকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি উচ্ছেদ করেননি। শিগগির আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট উচ্ছেদ অভিযান চালাবেন।’
রাজশাহীর নিউ কলোনির ছোট বনগ্রামে ছিল দীঘি, সেটি ভরাট করে প্লট তৈরি করছেন রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সভাপতি রমজান আলী – সমকাল
এ বিষয়ে রমজান আলীর ভাষ্য, ‘দুইতলা-তিনতলা ইজারা নেওয়া আছে। শুধু চার তলায় রান্নাঘর করেছি।’
১২২৫ টাকা ভাড়ায় রেলের ২০ কক্ষ: রাজশাহী স্টেশন ভবনের ওপরে ১৮টি আবাসিক কক্ষ, একটি রেস্তোরাঁ এবং একটি সম্মেলন কক্ষ দৈনিক ১ হাজার ২২৫ টাকা ভাড়ায় ইজারা পেয়েছেন রমজান আলী। ২০২০ সালে চার বছর মেয়াদে বছরে মাত্র ৪ লাখ ৪১ হাজার ১৬৮ টাকায় রমজান আলীকে এই ২০টি কক্ষ ইজারা দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০১৬ সালে আরও কম টাকায় এই ২০টি কক্ষ ইজারা পেয়েছিলেন রমজান আলী। তখন এর জন্য তাকে দৈনিক মাত্র ৮৪০ টাকা ৩০ পয়সা ভাড়া দিতে হতো।
অভিযোগ রয়েছে, টেন্ডারে কাউকে অংশ নিতে না দিয়ে নামমাত্র মূল্য বারবার ইজারা নেন রমজান আলী।
বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে স্বাভাবিক দরে এতগুলো কক্ষ ভাড়া নিতে গেলে দিনে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, ‘প্রতি চার বছর পরপর দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হয়। রমজান আলীর চেয়ে বেশি দাম কেউ দেয় না।’
এ বিষয়ে রমজান আলী বলেন, ‘রেল স্টেশনে প্রচণ্ড শব্দ হয়। ভিআইপিরা কেউ থাকতে চায় না। কেউ বিপদে পড়লেই কেবল এখানে থাকে। এ কারণে ভাড়াও কম। যে টাকায় ইজারা নিয়েছি সেটা কম নয়। বরং আমি ছাড়া আর কেউই এখানে এত টাকায় ইজারা নেবে না।’
রেলের ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রক: রমজান আলীর প্রধান পেশা রেলের ঠিকাদারি। সব টেন্ডার কাজের দেনদরবার তার মাধ্যমেই হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও রেলের ঠিকাদার আশরাফ হোসেন বাবু বলেন, ‘রমজান আলী কখনোই টেন্ডারে অংশ নিয়ে প্রতিযোগিতা করে কাজ পাননি। সব কাজ প্রভাব খাটিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া বহু লোককে রেলে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘তার (রমজান) সঙ্গে ছয় বছর আমার ব্যবসা ছিল। এ সময় আমার ১ কোটি টাকা ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন রমজান আলী। টাকা চাইলে যুবলীগ থেকে বহিস্কার করাসহ নানা হুমকি দেন। এ নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে সালিশেও বসেছিলাম।’
এ বিষয়ে যুবলীগ সভাপতি রমজান আলী বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত রেলে মাত্র ৭ কোটি টাকার টেন্ডার পেয়েছি। অনেকে টেন্ডার নিয়ে বিভিন্ন কারণে কাজ করতে পারেনি। তখন তারা সেই টেন্ডার বিক্রি করে দিলে আমি কিনে কাজ করেছি।’
আশরাফ হোসেন বাবুর অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সে আমার কর্মচারী ছিল। আমার ব্যবসা দেখভাল করত। সে আমার কাছে টাকা পায় না। তার বাড়িঘর সবকিছু বিক্রি করেও তো ২৫ লাখ টাকা হবে না। তাহলে এত টাকা কীভাবে পায়?’
দুর্বল মালিকানার জমির দখলদার: ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিউ কলোনিতে ছোট বনগ্রাম মৌজার দীঘলকান্দি ঝিল আড়াই বছর আগে দখল করে। এরপর ভরাট করে বিক্রি করেন রমজান আলী। পুকুর বা ঝিল ভরাট করা বেআইনি হলেও তিনি তা ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করেছেন। ১০ লাখ টাকা কাঠা দরে চার বিঘা জমিটি প্রায় ৮ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন। স্থানীয় অনেকে জানালেন, জিতেন্দ্র নারায়ণ জমিদার ছিলেন। তিনি জমিটি কাউকে দান বা বিক্রি করেননি। বরং দখলদাররা জাল দলিল করে বিক্রি করছেন।
ছোট বনগ্রাম নিউকলোনির সেই ঝিলে গিয়ে দেখা গেছে, ঝিল বা পুকুরের কোনো অস্তিত্ব নেই। বালু ভরাট করে প্লট আকারে ইটের গাঁথুনি দিয়ে ভাগ করে রাখা হয়েছে।
সেখানে বাগমারার মকবুল হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে দেখা গেল, দুই কাঠার একটি প্লটে শ্রমিক দিয়ে ভবন নির্মাণের ভিত দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ইব্রাহিম ঢাকায় চাকরি করে। রমজান ও ইসমাইলের মাধ্যমে দুই কাঠা জমি ৯ লাখ টাকা দরে কিনেছে। ৫ তলা বাড়ি বানানো হবে।’
স্থানীয় রিকশাচালক নয়ন বলেন, ‘যুবলীগ নেতা রমজান দাদা এখানকার পুকুরটি ভরাট করেছেন। এখন প্লট আকারে বিক্রি করছেন।’
জায়গাটির পাশের বাড়ির বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, ‘এখানে অনেক পুরোনো পুকুর ছিল। খাস জমি। কাশেম মিয়ার দখলে ছিল। পরে রমজান ভরাট করে বিক্রি করে দিয়েছেন। আমার ঘরের পাশেই দুই কাঠা জমি আমি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ১০ লাখ টাকা কাঠা দাম চায়। এত টাকা দেব কোত্থেকে?’
গৃহবধূ নিপা বলেন, রমজানকে বিক্রি করতে আসতে দেখেছি। কারা কিনেছে জানি না। রমজানকে দেখতাম আসতে।’
এ বিষয়ে রমজান আলী বলেন, ‘এই জমি আমি কমিশনের বিনিময়ে ভরাট করে বিক্রি করতে সহযোগিতা করেছি মাত্র। আমি মালিক না, আর নিজে বিক্রিও করিনি। সাইদুর রশিদ ও খলিল চৌধুরীর ওয়ারিশরা জমির রেজিস্ট্রি দিয়েছেন।’
সিটি করপোরেশনের ভেতর পুকুর ভরাট নিষিদ্ধ হওয়ার পরও কেন ভরাট করা হলো জানতে চাইলে রমজান বলেন, ‘এটা ঠিক পুকুর না, লেটাপুকুর। সামান্য গর্ত ছিল, ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হিসেবে সবাই ব্যবহার করত। ভরাট করায় এলাকার পরিবেশ সুন্দর হয়েছে।’
রাজশাহীর রেলস্টেশনের ভবনে লিজ নিয়ে গড়ে তোলা তার আবাসিক হোটেল – সমকাল
শুকনাদীঘিরও মালিক: নামে শুকনাদীঘি হলেও পানি অথৈ। সপুরায় অবস্থিত এ পুকুরটিও যুবলীগ সভাপতি রমজান আলীসহ ছয়জন ‘কিনে’ নিয়েছেন। এখন এটি ভরাট করার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে কিছু অংশে মাটি, ময়লা ফেলে ভরাট করেছেন। এই দীঘি ক্রয়ে ৬ ভাগের এক অংশ বাবদ ৫৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকা আয়কর বিভাগকে দেখিয়েছেন তিনি।
রমজান আলী বলেন, ‘ভরাট করে প্লট বিক্রি করার জন্য ছয়জন মিলে ভাগে কিনেছিলাম। কিন্তু মেয়র সাহেব এই পুকুর সৌন্দর্যবর্ধন করার জন্য সংরক্ষিত করেছেন। তাই কয়েকজন নিজের অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন। আমার অংশটাও বিক্রি করে দেব।’
বাশার রোডে দুই বিঘা: বাশার রোডে মালিকানা নিয়ে জটিলতায় থাকা দুই বিঘা জমি কিনেছেন রমজান আলী। এই জমি কেনার কয়েক কোটি টাকা আয়কর ফাইলে ওঠাননি তিনি। এ বিষয়ে রমজান বলেন, ‘জমিটি মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন বাচ্চু ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারসহ তিনজনে মিলে সোয়া কোটি টাকায় কেনার জন্য ৫৭ লাখ টাকা বায়না করেছিলাম। কিন্তু আরডিএ ছাড়পত্র দিচ্ছে না। পরে জানতে পারি এখানে আরডিএ কর্তৃপক্ষ খোলা স্থান (ওপেন স্পেস) হিসেবে নকশায় দেখিয়েছে। এ কারণে জমির মালিক উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন। তাই রেজিস্ট্রি হয়নি। এ কারণে আয়কর বিভাগকে দেখানো হয়নি।’
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নগর পরিকল্পনাবিদ আজমেরী আশরাফী বলেন, ‘আমাদের মাস্টারপ্ল্যানে ওপেন স্পেস থাকে। কিন্তু জমির মালিকানা নিয়ে আমরা সরাসরি মালিককে কিছু বলতে পারি না। ওপেন স্পেসে ভবন করার জন্য কেউ আবেদন করলে অনুমোদন দেই না। তবে বাসার রোডে এত বড় ওপেন স্পেস আমাদের পরিকল্পনায় নেই।’
রমজান আলীর তিন ছেলের নামেও রয়েছে অনেক সম্পদ। বড় ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার সোহেল রানা। তানোরে কয়েক বিঘা জমি কিনে সেখানে করেছেন পুকুর, খামার ও বাগান। তার রয়েছে দুটি প্রাইভেটকার। মেজ ছেলে মিজানুর রহমান জুয়েল করেছেন পোশাক কারখানা। তারও একটি প্রাইভেটকার রয়েছে।
রমজান আলী বলেন, তানোরে বড় ছেলে ৩ বিঘা জমি কিনে পুকুর করেছে। আরও ১০ বিঘা জমি ইজারা নিয়েছে। সেখানে জমির দাম কম। গাড়িগুলো পুরোনো। এক দেড় লাখ টাকা দাম হবে। তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যারা এসব তথ্য দেয় তারা হাইব্রিড। দীর্ঘদিন থেকে যুবলীগের নেতৃত্ব দিচ্ছি। এ কারণে শত্রুতা করে এসব তথ্য দেয়।’