সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

সাংবাদিকদের ওপর হামলা-সহিংসতা বেড়েছে, কমেছে মামলা-গ্রেফতার

চার বছর আগে পাস হয় ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’। পাসের পর থেকে সাংবাদিকদের ওপর প্রয়োগ শুরু হয় এ আইন। তবে এই আইনে করা মামলার অধিকাংশই ‘হয়রানিমূলক’ হওয়ায় শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ার আগে যাচাইয়ের নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী। এরপর থেকে মামলা-গ্রেফতার আগের তুলনায় কিছুটা কমলেও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে হামলা ও সহিংসতা। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই সাংবাদিকরা এসব সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

 

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের তথ্যমতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত আড়াই বছরে ১৮১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৯২টি মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকতে হয়েছে ৫৩ জনকে। ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৪১টি মামলা হয়। এসব মামলায় আসামি হন ৭৫ সাংবাদিক। এর মধ্যে গ্রেফতার হন ৩২ জন। ২০২১ সালে দায়ের করা হয় ৩৫টি মামলা, আসামি করা হয় ৭১ সাংবাদিককে, গ্রেফতার হন ১৬ জন। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত শুধু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ১৩টি মামলা, আসামি করা হয় ৩১ জনকে। এর মধ্যে গ্রেফতার হন পাঁচজন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) দেওয়া তথ্যেও দেখা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা প্রতি মাসেই কমছে। সাংবাদিকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে রাজধানীতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪১টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩৪টি, মার্চে ২২টি, এপ্রিলে ২৪টি, মে এবং জুন মাসে ১৯টি করে, জুলাইয়ে ১৬টিসহ মোট ১৭৫টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোতে সাংবাদিকসহ আসামি হয়েছেন ৩১১ জন।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা কমার পেছনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেন খর্ব না হয় এবং কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সে দিকটি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। ফলে কিছুটা যাচাই বাছাই করে মামলাগুলো নেওয়া হয়। কোনো মন্তব্য করলেই যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ভোগ করতে হবে বিষয়টি এমন নয়।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন্স) মো. ফারুক হোসেন  বলেন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যদি ব্যঙ্গ করা হয়, মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়, যখন কোনো মামলা হয় সেক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। তবে কোনো সাংবাদিক ভুলবশত যদি কোনো প্রতিবেদন করেন, সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া থাকে। যেহেতু বাছাই করে মামলা নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে মামলার সংখ্যা কমতে পারে।

সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। এ পেশায় ঝুঁকি সব সময়ই থাকে। তবে সাংবাদিকদের ওপর যদি কেউ হামলা করে অথবা তার কোনো প্রতিবেদনের কারণে তাকে যদি হেনস্তা করে, সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে মেসেজ এলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেই। ভুক্তভোগী সাংবাদিককে আমাদের আইনি সহায়তা দেই।

বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) ২০২২-এর প্রকাশিত বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার ছাড়া ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারতেরও নিচে রয়েছে বাংলাদেশ।

সাংবাদিকদের ওপর হামলা-সহিংসতা বেড়েছে, কমেছে মামলা-গ্রেফতার

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার করা হয় জাগো নিউজের জেলা প্রতিনিধি তানভীর হাসান তানুকে, ফাইল ছবি

এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার কমলেও বাড়ছে হামলা, হুমকি, হয়রানি, সম্পদ বিনষ্ট ও বৈষম্যমূলক আচরণের মতো সহিংসতা। সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন বেশি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ পাস হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার সাংবাদিক লাঞ্ছনা, হয়রানির শিকার এবং গুম ও প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন। সংগঠনটি বলছে, গত চার বছরে মামলার সংখ্যা কমলেও সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হয়রানি বেড়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ১৪২ জন, ২০২০ সালে ২৪৭ জন, ২০২১ সালে ২১০ জন এবং ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ১১৯ জন এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন। এছাড়া চলতি মাসে এরই মধ্যে ১৫ জনের বেশি সাংবাদিক হামলা ও হুমকির শিকার হয়েছেন।

আর্টিকেল নাইনটিনের বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘গ্লোবাল এক্সপ্রেশন রিপোর্ট ২০২২’ অনুসারে ১৬১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ১৩১তম। সংস্থাটির হিসাব মতে, ২০২০ সালে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৫৭৯ জন সাংবাদিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। মতপ্রকাশজনিত অধিকার লঙ্ঘনের ৩৪৪টি ঘটনায় শারীরিক হামলা, মামলা, অপহরণ, হুমকি, হয়রানি, সম্পদ বিনষ্ট ও বৈষম্যমূলক আচরণের মতো সহিংসতার শিকার হয়েছেন তারা। ২০২১ সালে ঘটেছে ৪৩৯টি ও ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্তই ৪৪৯টি হামলা এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়ে ৭১ টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার নাদিয়া শারমিন  বলেন, যারা সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে তাদের আসলে মনের মধ্যে ভয় আছে। ভয়টা দুর্নীতি, অনিয়ম ও অন্যায় ধরা পড়ার। এ অন্যায়টা যারা সমর্থন করেন বা প্রশ্রয় দেন, তারা দেশের উপকার কখনোই করেন না। সাংবাদিকদের ওপর যারা হামলা করছে এবং তাদের যারা আইনের আওতায় আনবেন না, তারাও দেশের ক্ষতিই করছেন। কাজেই বাংলাদেশের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও এই মুহূর্তে গণতন্ত্রের জন্য খুবই জরুরি। প্রকাশিত সংবাদে কোনো ভুল বা মিথ্যা তথ্য থাকলে আগে সেটির প্রতিবাদ করা হতো প্রতিষ্ঠানের বা প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে। এখন সেটি করা হয় হামলা, হুমকি বা মামলা করে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) সভাপতি মির্জা মেহেদী তমাল  বলেন, সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিবাদের ভাষার ধরন পাল্টে গেছে। আগে কোনো প্রতিবেদন পছন্দ না হলে প্রতিবাদ করা হতো প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগের মাধ্যমে। কিন্তু এখন দেখা যায় ক্ষোভ প্রকাশ করছে সন্ত্রাসী কায়দায়। কোনো বিচার না হওয়ায় তারা মনে করে এগুলো করলে কিছুই হবে না। যে মারবে সেই উপরে থাকবে। এ ধরনের একটা মানসিকতা আমাদের এখানে তৈরি হয়েছে।

সাংবাদিকদের ওপর হামলা-সহিংসতা বেড়েছে, কমেছে মামলা-গ্রেফতার

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন দৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পাহাড় টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক ফজলে এলাহী

তিনি বলেন, অনেক সাংবাদিক এগুলো এড়িয়ে যান। কিন্তু এগুলোর প্রতিবাদ করতে হবে, মামলাও করতে হবে। সাংবাদিক সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের আইনি সহযোগিতা দেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক  বলেন, সাংবাদিকরা হুমকির সম্মুখীন হবেন এটা জেনেই সাংবাদিকতা পেশায় আসেন। সারা পৃথিবীতেই সাংবাদিকতা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। কারণ সাংবাদিকরা সত্য নিয়ে কাজ করেন। সত্যের শত্রু সর্বত্র বিরাজমান। অতএব সত্য যেহেতু প্রকাশ করবে, সত্যের শত্রুরা তার ওপর আক্রমণ করবেই।

সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হুমকি প্রতিহত করার বিষয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের সতর্ক থাকতে হবে। রাষ্ট্রে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা যদি থাকে সেই রাষ্ট্রের বহু সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যায়।

Facebook
X
WhatsApp
Email
Telegram
সর্বশেষ
ফেসবুক নেটওয়ার্ক ও পার্টনার পেজ
মিডিয়া
Cover for Table Talk Uk
595,824
Table Talk Uk

Table Talk Uk

Table Talk UK Discusses the political and social issues of the country. Our only purpose is to expose social inconsistencies and politics in the face of accountability on the path to democracy and talk about the rights of people.

This message is only visible to admins.
Problem displaying Facebook posts. Backup cache in use.
PPCA Error: Due to Facebook API changes it is no longer possible to display a feed from a Facebook Page you are not an admin of. The Facebook feed below is not using a valid Access Token for this Facebook page and so has stopped updating.

Smash Balloon Custom Facebook Feed WordPress Plugin The Custom Facebook Feed plugin

সর্বশেষ সংবাদ জানতে—এখনই সাবস্ক্রাইব করুন!
সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
কপিরাইট © 2025 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত — লন্ডন মিরর।
সম্পাদক: হাসিনা আক্তার
সার্চ করুন
লগইন/সাইন আপ
সর্বশেষ সংবাদ জানতে—এখনই সাবস্ক্রাইব করুন!