‘আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারবো না’’; ‘‘আমি আত্মগোপনে আছি, আপনার সাথে ফোনে কথা বলতে পারি’’; ‘‘আমি নিরাপদ কোনও স্থানে আপনার সাথে দেখা করার চেষ্টা করবো’’; ‘‘আপনার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হবে, যে কারণে আমি আপনার সাথে দেখা করতে পারবো কি না জানি না।’’
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও পূর্ববর্তী সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট অ্যাকটিভিস্টদের কাছ থেকে এসব বার্তা পেয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। গত এক সপ্তাহ ধরে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক শুভজিত রায় বাংলাদেশের অজ্ঞাত কিছু স্থানে তাদের কয়েকজনের সাথে দেখা করেছেন এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতিশোধের ভয়ে আত্মগোপনে থাকা এসব ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন।
তাদের সবাই প্রায় একটি কথা বলেছেন, ‘‘হাসিনা দল ও জনগণকে ত্যাগ করেছেন।’’ আওয়ামী লীগের এক নেতা শেখ হাসিনার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘আপা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’’
নেতাকর্মীদের রেখে চলে যাওয়ার এই একই অনুভূতি আরও অনেকে শেয়ার করেছেন। যারা ৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আগে কোনও আঁচই পাননি। সেই দিন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং তার বোন শেখ রেহানাসহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ বর্তমানে ভারতে রয়েছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলেছে, শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তার মন্ত্রিসভা, এমনকি তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরও ‘‘একেবারে বিস্মিত’’ করেছে। আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছেন, ‘‘আমরা তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে টেলিভিশন থেকে জানতে পেরেছি।’’
শেখ হাসিনার এভাবে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাদের জীবনকে বিপদে ফেলেছে এবং বিক্ষুব্ধ জনতা—বিক্ষোভকারী, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এবং সুযোগসন্ধানীরা আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং পার্টি অফিসগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছে। তারা সেগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ভাঙচুর করছে, লুটপাট করছে।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, ‘‘আমরা ঠিক সময়েই আমাদের বাড়ি থেকে বের হতে পেরেছিলাম, যখন সেনাপ্রধান বিকেল ৩টার দিকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন এবং লোকজন টিভি পর্দায় নজর রাখছিল।’’
আরেক নেতা, যিনি শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি বলেন, ‘‘ধরা পড়লে আমার পরিবার ও আমাকে পিটিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো।’’
আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বিরোধীদলের নেতারা শেখ হাসিনা সরকারের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। তাদের জেলে ভরানো হয়েছে, মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানি করা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে পরিস্থিতি বদলে যায়।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় কেউ কেউ বিশেষ করে জুলাই মাসে ছাত্র ও বিক্ষোভকারীদের ওপর যখন গুলি চালানো হয় এবং তারপর ৩-৪ আগস্ট লোকজন রাস্তায় নেমে আসেন, তখন দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বিক্ষোভকারীরা ৫ আগস্ট, যেদিন সরকার পতন হয়েছিল সেদিন কারফিউ ভাঙেন।
সরকারের পতনের ঘটনায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ একটি গোষ্ঠীকে দায়ী করে একজন নেতা বলেন, ‘‘তিনি (শেখ হাসিনা) আমাদের কথা শোনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নেতাদের একজন এই গোষ্ঠীকে ‘‘দ্য গ্যাং অব ফোর’’—বলে অভিহিত করেছেন। যারা তাকে (শেখ হাসিনা) মাঠের বাস্তব অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
এই গ্যাং অব ফোর হলেন, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেন, ‘‘এই গ্যাং অব ফোরই তার পতনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর এই চারজনের প্রতি শেখ হাসিনার অন্ধ বিশ্বাস ছিল এবং অতীতে তার যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল, তা তাদের কারণেই হারিয়েছেন।’’
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিএনপিকে নির্বাচনে না আনাকে শেখ হাসিনার ‘‘বড় ভুল’’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। একাধিক সূত্র বলেছে, আওয়ামী লীগের কিছু নেতা লন্ডনে বিএনপি নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের সাথে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলেন।
একটি সূত্র বলেছে, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার বিষয়ে একটি ব্যাকচ্যানেলের মাধ্যমে প্রস্তাবও করা হয়েছিল। আমরা ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের এক বছর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তারেকের সাথে ওই চ্যানেলটি প্রতিষ্ঠা করার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু শেখ হাসিনা এই প্রস্তাবে সবুজ সংকেত দেননি।
আওয়ামী লীগের একজন নেতার মতে, বিএনপির প্রধানের ছেলের সাথে যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টিতে অস্বীকৃতি জানানোই ছিল শেখ হাসিনার জন্য বড় ভুল। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আনার জন্য বিএনপিকে প্রস্তুত করা হলে তা বিরোধীদের ক্ষোভ ও অভিযোগকে লাঘব করতো।