দেশের উত্তর ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানির সমতল কমছে। ফলে ধীর গতিতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে শুক্রবার জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। জেলার আটটি উপজেলায় ২০ লাখের বেশি মানুষ বর্তমানে পানিবন্দি অবস্থায় ঘরে রয়েছেন।
টানা ভারী বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢলে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। বন্যার পানিতে লাখ লাখ মানুষের বাড়িঘর, ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। সেসব এলাকায় তৈরি হয়েছে মানবিক বিপর্যয়।
গত দু’দিনের বন্যায় বিপর্যস্ত ১২জেলা। ২০ আগস্ট থেকে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির পর এখন পর্যন্ত ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত ৩০ বছরে এমন বন্যা দেখেনি এসব জেলার মানুষ। এই বন্যার আসল কারণ কি? এতে কি প্রতিবেশী দেশ ভারতের কোন হাত রয়েছে?
এমন সব প্রশ্নই গত কয়েক দিন ধরে ঘুরছে জনমনে। বলা হচ্ছে, ভারতের ত্রিপুরার গোমতী নদীর উপর ডম্বুর ড্যাম ৩১ বছর পর ভারী বর্ষণের কারণে খুলে দেয়া হয়েছে। অনেকেই ধারণা করছেন, এই ড্যাম খোলার কারণেই বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ সম্পর্কে কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার নিশাত দ্য বিজনে স্ট্যান্ডার্ডের বাংলা সংস্করণে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বৃষ্টির ব্যাপারে জানতো আবহাওয়া অধিদপ্তর, কিন্তু তারা সতর্ক করেনি।
তিনি বলেছেন, ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি) দিল্লিতে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় কমলা সতর্কতা জারি করেছে এবং ত্রিপুরায় রেড অ্যালার্ট জারি করেছে।এসব তথ্য বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরও পেয়েছে।তারা তাদের রাডারের মাধ্যমে বৃষ্টির বিষয়টি জানতে পেরেছে।
‘কিন্তু আমাদের কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া হয়নি। যদি একদিন আগেও আমাদের সতর্ক করা হতো, তাহলে আমরা নিজেদের প্রস্তুত করতে পারতাম।পানি মন্ত্রণালয়, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকারকে এই বিষয়ে দায়ি করা উচিত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আধুনিকায়ন প্রয়োজন’।
ড. আইনুন নিশাত আরও জানান, স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে ড্যাম এবং পানি রোধী বেষ্টনীগুলো নিয়ে ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে এবং এগুলো বিভ্রান্তি তৈরি করছে। ড্যামকে ‘বাঁধ’ বলা ঠিক নয়। জলাধার হিসেবে ব্যবহারের জন্য মূলত নদীর ওপর এসব ড্যাম তৈরি করা হয়। অপর দিকে বাঁধ হলো পানিরোধী বেষ্টনী, যা পানি উপচে পড়া থেকে রক্ষা করে।
এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহর নাঈম ওয়াহরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ড্যামগুলো খুলে দেয়ার আগে ভারত আমাদের আগাম নোটিশ দিতে পারতো।আমরা এর আগেও দিনাজপুর জেলায় এমন একটি পরিস্থিতি দেখেছিলাম। সেখানে তারা অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ড্যাম খুলে দেয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসককে জানিয়েছিল। কিন্তু এবার তারা তা করেনি।
তিনি আরও বলেন, ভারত দুই বা ততোধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীর ওপর ব্যারেজ নির্মাণ করতে পারেনা।আমাদের উচিত এই বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করা। তবে যাই হোক, বন্যার একমাত্র কারণ কিন্তু এটি না।আমাদের নিজেদের দুর্বলতাগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে, যাতে আমাদের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে প্রস্তুত থাকে।
গওহর নঈম বলেন, ভারতে পানি ছাড়ার আগে বৃষ্টি হয়েছে।প্রকৃত পক্ষে এই বৃষ্টি ও বন্যার সম্ভাবনা প্রায় ১০দিন আগেই স্পষ্ট ছিল।তবে আবহাওয়া অধিদপ্তর কোনো পূর্বাভাস দেয়নি। জনগণকে সতর্ক করা প্রাথমিক দায়িত্ব এবং কেন তা করা হয়নি তার জন্য অবশ্যই জবাবদিহিতা থাকা উচিত।
এদিকে, দৈনিক সমকালে ২৩ আগস্ট প্রকাশিত এক কলামে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত লেখেন, নদীর বর্তমান অবস্থা কী, পানি কী হারে বাড়ছে তা জানানোর বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চুক্তি রয়েছে।তথ্য জানানোর প্রক্রিয়া ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে শুরু হয়। আমি তার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সেসময়।
তিনি আরও লেখেন, আমার ধারণা, গোমতীর অবস্থা কী, তা ভারত জানিয়েছে।তিন- চার দিন আগে থেকেই আমাদের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রগুলো এই তথ্য জানিয়ে আসছে। আমরা বিষয়টি দেখিনি, পূর্বাভাসের তথ্য নাড়াচাড়া করিনা।
এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, দেশের পূর্বাঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লাসহ ভারতের ওপারের জেলাগুলোতে গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাত প্রায় অস্বাভাবিক মাত্রায় বেশি ছিল। আর যেটি বলা হচ্ছে, এ অঞ্চলে সচরাচর বন্যা হয় না।কিন্তু ৩০ বছর আগেও প্রায় প্রতি বছরই এখানে বন্যা হতো।পাঁচ-সাত বছর পর পর বড় আকারের বন্যা হতো। একারণে গোমতীকে বলা হতো কুমিল্লার দুঃখ।এখন বন্যা হয়না।
‘কারণ হচ্ছে বাঁধ পানি ধরে রাখে।এই বাঁধটা ভারত করেছিল তাদের উপকারের জন্য, তাতে আমাদেরও কিছু উপকার হয়েছিল। চট্টগ্রাম-রাঙ্গুনিয়ায় আগে প্রতিবছরই বন্যা হতো, এখন হয়না। কারণ কাপ্তাই বাঁধ ও পানি ধরে রাখে।৩০ বছরেই আমরা কী করে ভুলে গেলাম যে প্রতি বছরই বন্যা হতো!’
ড. আইনুন নিশাত বলেন, আবহাওয়া-সংক্রান্ত যে নিয়ম-কানুনর রয়েছে।আমরা ও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) সদস্য, ভারত ও সংস্থাটির সদস্য। ডব্লিউএমওর হয়ে বিভিন্ন পয়েন্টের বৃষ্টিপাতের তথ্য ভারত সংগ্রহ করে, যেহেতু কার্যালয়টা দিল্লিতে।যে মুহূর্তে দিল্লি কার্যালয়ে ওই তথ্য পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় পাঠানো হয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভারত তথ্য প্রদান করছে বাংলাদেশকে।