তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে গত ৫ বছরে ১৪টি প্রতিষ্ঠান অন্তত ৬৮২ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান সিএন্ডএফ এজেন্টের সহায়তায় জাল কাগজপত্র বানিয়ে পণ্য বোঝাই শত শত কনটেইনার মধ্যপ্রাচ্যসহ ২৮টি দেশের অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানগুলো বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতি এবং অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ই-এক্সপি ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে এসব পণ্য রপ্তানি করে।
কিন্তু পণ্যগুলোর বিপরীতে প্রযোজ্য বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসেনি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এমনকি কাস্টমস কর্তৃপক্ষও কোনো প্রশ্ন তোলেনি, কারও বিরুদ্ধে তদন্তও হয়নি। তবে সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে। সংস্থাটির যুগ্ম পরিচালক মো. শামসুল আরেফিন খান সোমবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
জানা যায়, এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর তদন্ত শুরু করে। সেই সূত্র ধরে কয়েকটি কাগুজেসহ ১৪টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অভিনব কৌশলে জালিয়াতি করে দেশ থেকে অর্থ সরিয়েছে বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।
শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অবশ্য পোশাক রপ্তানির নামে অর্থ পাচারের সঙ্গে ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩০০ কোটি টাকা পাচারের সম্পৃক্ততার কথা জানাচ্ছে। কিন্তু ষ যে তথ্য রয়েছে, তাতে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৪। পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ৬৮২ কোটি টাকা। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর গত মার্চে তাদের প্রতিবেদনে বাকি চার প্রতিষ্ঠানের নাম এবং তাদের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ উল্লেখ করে।
সব মিলে ১৪টি প্রতিষ্ঠান নমুনা ঘোষণায় পণ্য রপ্তানি করে সমুদয় অর্থই বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি সংস্থাগুলোর নজর এড়াতে বিল অব এক্সপোর্ট জালিয়াতির মাধ্যমে অন্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ইএক্সপি (রপ্তানি অনুমতিপত্র) ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ১২৩৪টি পণ্যচালানে ৯১২১ টন পণ্য বিদেশে পাঠিয়েছে।
পণ্যের মধ্যে রয়েছে টি-শার্ট, টপস, লেডিস ড্রেস, ট্রাউজার, বেবি সেট, পোলো শার্ট ইত্যাদি। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, নাইজেরিয়ায় এসব পণ্য জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রপ্তানি করে।
যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পণ্য রপ্তানির নামে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে প্রজ্ঞা ফ্যাশন লিমিটেড, ফ্যাশন ট্রেড, এমডিএস ফ্যাশন, হংকং ফ্যাশনস লিমিটেড, থ্রি-স্টার ট্রেডিং, ফরচুন ফ্যাশন, অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, পিক্সি নিট ওয়্যারস লিমিটেড, স্টাইলাইজ বিডি লিমিটেড এবং ইডেন স্টাইল টেক্স।
সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাস্টমস আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর জানায়, আশুলিয়ায় প্রজ্ঞা ফ্যাশন ২০১৯-২০ সালে ৩৯১টি চালানের মাধ্যমে ৩ হাজার ৮০ টন টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের ম্ল্যূ ৯২ কোটি টাকা। গুলশানের ফ্যাশন ট্রেড ২০১৮-২০ সালে ২৪৬টি চালানের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, সুদান, মালয়েশিয়ায় টি-শার্ট, প্যান্ট, ট্যাংক-টপ, পাজামা রপ্তানি করেছে। এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য ৬৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। একই কায়দায় উত্তরার এমডিএস ফ্যাশন ৪৪ কোটি টাকা, গাজীপুরের হংকং ফ্যাশনস ৪০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, বনানীর থ্রি-স্টার ট্রেডিং ২৬ কোটি টাকা, মিরপুরের ফরচুন ফ্যাশন প্রায় ১৩ কোটি টাকা, কচুক্ষেতের অনুপম ফ্যাশন ওয়্যার ৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, টঙ্গী গাজীপুরের পিক্সি নিটওয়্যারস ৫ কোটি ৬ লাখ টাকা, শাহবাগের স্টাইলাইজ বিডি ২ কোটি ১৭ লাখ টাকা, খিলক্ষেতের ইডেন স্টাইল টেক্স এক কোটি ৬৪ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি করেছে।
শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিল অব এক্সপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে টি-শার্ট রপ্তানি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে টি-শার্টের অস্বাভাবিক ওজন দেখা গেছে। প্রতি পিস টি-শার্টের ওজন দেখানো হয়েছে ৫০০, ৮০০ গ্রাম বা ক্ষেত্রবিশেষে এক কেজির বেশি। প্রকৃতপক্ষে প্রতি কেজি নিট ফেব্রিক্স দিয়ে কমপক্ষে ৩-৬টি বড় আকারের টি-শার্ট বানানো যায়। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিটি টি-শার্টের গড় ওজন ন্যূনতম ২৫০ গ্রাম ধরে রপ্তানিকৃত টি-শার্টের সংখ্যা হিসাব করেছে। এছাড়া কিছু কিছু পণ্যচালানে রপ্তানি পণ্যের মূল্য খুবই কম ঘোষণা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সমসাময়িক রপ্তানি চালানের সমজাতীয় পণ্যের মূল্য বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্য অর্থ পাচারের তথ্য নির্ধারণ করেছে।
সূত্র আরও জানায়, কিছু প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। শাহবাগে স্টাইলাইজের ঠিকানায় রয়েছে পোশাকের শোরুম। আর কচুক্ষেতে অনুপম ফ্যাশনের ঠিকানায়ও অন্য প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে। ফলে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো আদৌ রপ্তানি করেছে কিনা, তা উদঘাটনে তদন্ত চলছে। কেননা সিএন্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও দায় স্বীকার করছে না।