রাষ্ট্র সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দেওয়ার কথাও জানান তিনি।
বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এসব কমিশন গঠনের কথা বলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা যেহেতু জনগণের ভোটাধিকার ও জনগণের মালিকানায় বিশ্বাস করি, সেহেতু নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নয়নে আমাদের সংস্কার ভাবনায় গুরুত্ব পেয়েছে। আমরা মনে করি নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া বা এর মাধ্যমে এক ব্যক্তি বা পরিবার বা কোনো গোষ্ঠীর কাছে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব আশঙ্কা রোধ করার জন্য নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশন সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কথা আমরা ভাবছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন এই চারটি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য। এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার জনমালিকানা ভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়ও অবদান রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, এর পাশাপাশি করে সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন আমরা অনুভব করছি ।
সরকারপ্রধান বলেন, এসব বিষয়ে সংস্কার করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে আমরা প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে এই কমিশনগুলি পরিচালনা করার দায়িত্ব দিয়েছি। এর পর আরো বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া আমরা অব্যাহত রাখবো।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সুজন সম্পাদক নির্বাচন বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সরফরাজ চৌধুরী, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে সাবেক আমলা ও তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন।
এসব কমিশনের অন্য সদস্যদের নাম কমিশন প্রধানদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হবে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, কমিশনগুলোর আলোচনা ও পরামর্শসভায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ছাত্র, শ্রমিক, জনতা আন্দোলনের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
ড. ইউনূস বলেন, পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হওয়ার পর কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে তার কাজ আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে শুরু করতে পারবে বলে আশা করছি এবং এটি পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আমরা ধারণা করছি। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শসভার আয়োজন করবে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র সমাজ, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক তিন থেকে সাত দিনব্যাপী একটি পরামর্শসভার ভিত্তিতে সংস্কার ভাবনার রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এতে এই রূপরেখা কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তার একটি ধারণাও দেওয়া হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই আয়োজন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তা বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্র পুনঃ নির্মাণ তাগিদের ঐক্যবন্ধনে গোটা জাতিকে শক্তিশালী ও আশাবাদী করে তুলবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, আমরা সংস্কার চাই। আমাদের একান্ত অনুরোধ, আমাদের উপর যে সংস্কারের গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব দিয়ে আপনারা দর্শকের গ্যালারিতে চলে যাবেন না। আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমরা একসঙ্গে সংস্কার করবো। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব।
তিনি বলেন, আপনারা নিজ নিজ জগতে সংস্কার আনুন। একটা জাতির সংস্কার শুধুমাত্র সরকারের সংস্কার হলে হয় না। আপনি ব্যবসায়ী হলে আপনার ব্যবসায় সংস্কার আনুন। ব্যবসায়ী গোষ্ঠীরা তাদের নিজ নিজ সমিতির মাধ্যমে সংস্কার আনুন। সমিতিতে সংস্কার আনুন। নতুন করে সমিতির গঠনতন্ত্র সংশোধন করুন। আপনি শ্রমিক হলে আপনার ক্ষেত্রে আপনি সংস্কার করুন। আপনি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী হলে আপনার ক্ষেত্রে সংস্কার করুন। আপনি প্রতিষ্ঠান প্রধান হলে আপনার প্রতিষ্ঠানে সংস্কার আনুন। আমি এটাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। এই সংস্কারের মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে চাই। আমাদের এই যাত্রা আমাদের পৃথিবীর একটি সম্মানিত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুক এটাই আমাদের সবার কাম্য।
ড. ইউনূস বলেন, বিগত মাসে আমি বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথকভাবে বসেছি। তাদের সঙ্গে মতামত বিনিময় করেছি। তারা আমাদের উৎসাহিত করেছেন। ছাত্র, শ্রমিক জনতার বিপ্লবের লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। সংস্কারের কাজে পূর্ণ সহযোগতিা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমি দেশের বিশিষ্ট সম্পাদকবৃন্দের সঙ্গে মত বিনিময় করেছি। তারাও সংস্কারের কাজে পূর্ণ সহযোগতিা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তারা বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। সবার পরামর্শ নিয়ে এখন আমাদের অগ্রসর হওয়ার পালা। আমি বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের কাছে আমাদের সরকারের লক্ষ্যগুলি ব্যাখ্যা করেছি। তারাও আমাদের লক্ষের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন।