পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার। কিন্তু এখানেই সংঘটিত হচ্ছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। ছাত্র-ব্যবসায়ী, যুবক-বৃদ্ধ, কারো না কারো তাজা প্রাণ ঝরছে। এনিয়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। ফলে প্রশ্নের মুখে পড়েছে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করছেন, গডফাদার ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে উপজেলা পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সখ্যতা রয়েছে। এ কারণে আইনের আওতার বাইরে থাকছে অপরাধীরা। সেই সুযোগ বেড়েই চলেছে খুন, ছিনতাই, মারামারি।
পুলিশের তথ্যমতে, গত দুই সপ্তাহে কক্সবাজারে ১৩টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আর ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে আটটির বেশি। এরমধ্যে গত পাঁচদিনে সাতজন হত্যার শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ অভিযুক্তরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে আবার খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি।
শুধু যে নগরীতেই খুনের ঘটনা ঘটছে তা নয়, সমানভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও চলছে হত্যাকাণ্ড। ঘুমন্ত বা জীবিত অবস্থায় স্ত্রী স্বামীকে কিংবা স্বামী স্ত্রীকে মারছেন। আর গুলি বা ধারালো অস্ত্রের হামলা তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- মো. সায়েম (২২) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার। গত সোমবার (১১ এপ্রিল) সকালে সদরের চৌফলদণ্ডী ব্রিজের নিচ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তবে এখনো তার মৃত্যুর কারণ অজানা।
একই সময়ে কক্সবাজারের ঈদগাঁওতে সেহেরি খেয়ে নামাজের জন্য বের হয়ে ছুরিকাঘাতে খুন হন তারেকুল ইসলাম (১৭) নামের এক দোকানি। তিনি ইসলামাবাদ ইউনিয়নের ওয়াহেদুর পাড়া এলাকার মৃত ছগির আহমদের ছেলে। তার হত্যাকারীকেও শনাক্ত করা যায়নি।
এর আগে গত ৪ এপ্রিল পিএমখালীতে ফুটবল খেলার ‘প্রাইজমানি’র টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মো. জাহাঙ্গীর (২২) নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরেরদিন ৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। জাহাঙ্গীর পিএমখালী ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম জুমছড়ি এলাকার ছৈয়দুল হকের ছেলে।
এই ঘটনার তিনদিন পর ৭ এপ্রিল সদরের পিএমখালীতে আরেকটি খুনের ঘটনা ঘটে। এদিন পানিসেচ প্রকল্পের বিবাদকে কেন্দ্র করে মোরশেদ আলী ওরফে মোরশেদ বলীকে (৩৮) কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ইফতারি কিনতে চেরাংঘর বাজারে গেলে সেখানে তার ওপর রড, ছুরি ও লাঠি নিয়ে হামলা হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করলেও মূলহোতাদের এখনো ধরতে পারেনি পুলিশ।
এর একদিন পরই ৮ এপ্রিল চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের মইক্কাঘোনা পাহাড়ি এলাকায় মো. ইউনুছ (৪০) নামের এক যুবককে মেরে ফেলা হয়। মোবাইলে জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে ঘটে এই হত্যাকাণ্ড।
সবশেষ ১২ এপ্রিল কক্সবাজার শহরের বাস টার্মিনালের আমগাছতলা এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আবুল কালাম (৪৫) নামে এক ব্যবসায়ী নিহত হন। এ ঘটনায় সম্পৃক্ত কাউকে আটক করতে না পারলেও পুলিশ রাতে সাড়াশি অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে আটক করে। তারা পেশাদার ছিনতাইকারী হিসেবে পরিচিত বলে দাবি করছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম
গত ১২ দিনে এসব হত্যাকাণ্ডের বাইরে আরও কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটে কক্সবাজারে। স্থানীয়ভাবে ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও নারী পুরুষসহ পাঁচজন খুন হন। এ জেলায় কিশোর গ্যাংয়েরও রয়েছে আধিপত্য।
গত ২৮ মার্চ কক্সবাজার শহরের সিটি কলেজ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে খুন হন কলেজছাত্র রিদুয়ান ছিদ্দিকী। রিদুয়ান সিটি কলেজ এলাকার বাসিন্দা ও চট্টগ্রাম মহসীন কলেজের ছাত্র। এই ঘটনায় র্যাব ও পুলিশ পৃথক অভিযান চালিয়ে তিনজনকে আটক করে।
সচেতন মহল বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সোচ্চার থাকলে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে না। প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হলে বাকি অপরাধীরা ভয় পাবে বলে মত দেন তারা।
এদিকে চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিত সবশেষ আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থিতরা বলেছেন, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় কমিটির সভা অনেকটা অকার্যকর হতে চলেছে। জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা বাস্তবায়নের জোর দাবি উঠেছে।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে। একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে কক্সবাজারে। এটি দুঃখজনক।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, কক্সবাজারের অবস্থা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। চরম উদ্বেগ পর্যায়ে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
এসব বিষয়ে কক্সবাজার সদর থানার ওসি (তদন্ত) মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, এরই মধ্যে রিদুয়ান ও মোরশেদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বেশ কয়েকজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। বাকি ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিষয়ে কাজ করছে পুলিশ। এর মধ্যে ১৯ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গত ১২ দিনে ১৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজারে। এগুলোর অধিকাংশ পারিবারিক ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক। সে হিসেবে এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন। তবে ছিনতাইকারীর হাতে খুন খুবই দুঃখজনক। ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসী ও অপরাধী ধরার জন্য পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। যেখানে অপরাধ সংঘটিত হয় সেখানেই দ্রুত অভিযান চালানো হয়।