কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর জাতির উদ্দেশে প্রথম বারের মতো ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি দেশের সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেন, তাদের পদক্ষেপ নিশ্চিত করেছে যে প্রতিটি সন্ত্রাসী এখন ‘নারীদের সিঁদুর মুছে ফেলার মূল্য জানে’।
প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, আমি এই জাতির মা, বোন এবং কন্যাদের উদ্দেশে ‘অপারেশন সিঁদুর’ উৎসর্গ করছি। অপারেশন সিঁদুর কেবল একটি নাম নয়, এটি জনগণের অনুভূতির প্রতিফলন।
অপারেশন সিঁদুরকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের নীতি উল্লেখ করে নরেন্দ্র মোদী বলেন,
পাকিস্তানে সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংসকারী অপারেশন সিন্দুর কেবল একটি অভিযান ছিল না। বরং এটি একটি মতবাদগত পরিবর্তন এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি নীতি ছিল।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সাহায্যের পরিবর্তে পাকিস্তান ভারতের ওপর আক্রমণ করেছে বলে উল্লেখ করে নরেন্দ্র মোদী।
পাক অধিকৃত কাশ্মীর ছাড়া (পিওকে) কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয় জানিয়ে নরেন্দ্র মোদী বলেন, জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি ছাড়া অন্য কিছু সহ্য করবে না।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সাহসিকতার প্রশংসা করেন এবং পেহেলগামে হামলার বর্বরতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। মোদী হামলায় নিহত ২৬ জনের জন্য শোক প্রকাশ করেন, যাদের মধ্যে অনেকেই বেসামরিক নাগরিক ছিলেন।
তিনি বলেন, সন্ত্রাসীদের নৃশংসতার জন্য দায়িদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়া প্রয়োজন। সাত মে বিশ্ব এই উদ্যোগকে কার্যকর হতে দেখেছে। আমরা তাদের (সন্ত্রাসী) প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে হামলা করেছি। তারা কখনও ভাবেনি ভারত তাদের ওপর হামলা করবে। কিন্তু যখন ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন পাকিস্তানে হামলা চালায়, তখন এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ভিত কেঁপে ওঠে। তারা আমাদের বোনদের সিঁদুর মুছে ফেলে, আমরা তাদের কেন্দ্রগুলি মুছে ফেলেছি।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সামরিক অভিযান বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী বাহিনীকে সতর্ক করে দিয়েছে। ..যদি তারা ভারতে আক্রমণ করে, আমরা জবাব দেবো এবং সন্ত্রাসবাদের শিকড় ধ্বংস করবো।
তিনি বলেন, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির সঙ্গে ‘শর্ত’ জুড়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পেহেলগাম পরবর্তী অসামরিক পদক্ষেপের অংশ হিসাবে ভারতের স্থগিত করা সিন্ধু জল চুক্তি পুনরায় সক্রিয় করা। কিন্তু ভারত দৃঢ়ভাবে এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছে।
নরেন্দ্র মোদী বলেন, ভারত বারবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনের অভিযোগ করেছে। জানানো হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীরকে অবৈধভাবে দখল করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ভারতীয় মাটিতে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু পাকিস্তান বারবার ভারতের ওপর হামলায় জড়িত সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোরে সঙ্গে কোনো সংযোগ থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে, তারা সন্ত্রাসবাদকে আশ্রয় বা অর্থায়ন করে না।
তবে ভারত ২০০১ সালে সংসদে হামলা, ২০১১ সালে মুম্বাইতে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ভয়াবহ গুলি চালানো এবং ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে উরি ও পুলওয়ামায় সৈন্যদের ওপর হামলাসহ ভারতের মাটিতে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের সংযোগের প্রমাণ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে পেহেলগামে হামলার তদন্তে পাকিস্তানের যোগসূত্রও উঠে এসেছে। পাঁচ সন্ত্রাসীর মধ্যে তিন জন পাকিস্তানি নাগরিক এবং পাকভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একটি অংশ রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট দায় স্বীকার করেছে। এই মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে পাকিস্তানের সেই বক্তব্য পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
গত সপ্তাহে অপারেশন সিন্দুরে নিহত সন্ত্রাসীদের জানাজায় পাক সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতির কথাও তুলে ধরেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
নরেন্দ্র মোদী বলেন, পেহেলগামে ভারতের সামরিক প্রতিক্রিয়ায় অপারেশন সিঁদুর ছিল পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ৯টি সন্ত্রাসী শিবির লক্ষ্য করে নির্ভুল হামলা। যার মধ্যে লস্কর-ই-তৈয়বা এবং পাক-ভিত্তিক জইশ-ই-মোহাম্মদের সদর দপ্তরও ছিল।
বছরের পর বছর ধরে অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা কাশ্মীর বিরোধ সমাধানের জন্য মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে, পাকিস্তানও তা চেয়েছিল। এই বিষয়ে ভারতের অবস্থান কখনও পরিবর্তিত হয়নি। কাশ্মীর একটি দ্বিপাক্ষিক সমস্যা, যা কেবল পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সমাধান করা যেতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পও একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু মিথ্যা দাবি করা হয় যে, মোদী তাকে হস্তক্ষেপ করতে বলেছিলেন। ট্রাম্প তখন এই দাবি করেছিলেন, যখন তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার পাশে ছিলেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে এটি অস্বীকার করে ঘোষণা করে যে, এ ধরণের কোনো অনুরোধ করা হয়নি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যেকোনো আলোচনার জন্য সীমান্তের আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
এখন তার দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প রোববার সেই প্রস্তাবটি পুনরাবৃত্তি করেছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেছেন, আমি আপনাদের দুজনের সঙ্গে কাজ করে দেখব যে, কাশ্মীরের বিষয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায় কিনা।
এসময় পারমাণবিক হুমকি সহ্য করা হবে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ভারত কোনো ‘পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইল’ সহ্য করবে না। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপারেশন সিঁন্দুর কেবল স্থগিত রাখা হয়েছে, এর ভবিষ্যৎ তাদের আচরণের ওপর নির্ভর করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান এবং তার কর্মকাণ্ডের ওপর কড়া নজর রাখছে ভারত।
তিনি আরও বলেন, সন্ত্রাস এবং আলোচনা এক সঙ্গে চলতে পারে না; সন্ত্রাস এবং বাণিজ্য একসাথে চলতে পারে না; এবং জল এবং রক্তও এক সঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না। পাকিস্তানকে যদি বাঁচতে হয় ওদের সন্ত্রাসের পরিকাঠামো নির্মূল করতে হবে।
নরেন্দ্র মোদী বলেন, পাকিস্তান আমাদের স্কুল-কলেজ, সাধারণ নাগরিকের বাড়িঘর, মন্দিরকে টার্গেট করলো। এখানেও ওরা ব্যর্থ হলো। দুনিয়া দেখলো কীভাবে পাকিস্তানের ড্রোন, মিসাইল ভারতের কাছে ধুলিসাৎ হলো। আকাশেই নষ্ট করে দেওয়া হলো। তিন দিনে পাকিস্তানকে যা করা হয়েছে, যা ওরা ভাবতেই পারেনি। এখন ওরা বাঁচার রাস্তা খুঁজছে। দেশে দেশে ঘুরছে। খারাপ ভাবে হেরে যাওয়ার পরে ১০ মে পাকিস্তানি সেনা আমাদের ডিজিএমও-র দ্বারস্থ হন। তার আগে আমরা পাকিস্তানের মাটিতে থাকা সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছি।
তিনি বলেন, যখন দেশ একজোট হয়, যখন সবার আগে দেশ আসে, তার ফল মেলে। যখন পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদকে গুঁড়িয়ে দিতে ভারত হামলা চালাল, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনই নয়, তাদের মনোবলও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।