স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর এবং আল শামসের তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। মূলত আইনি বাধার কারণেই আটকে আছে এ তালিকা প্রকাশ।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়, যা ছিল বিতর্কিত এবং ত্রুটিপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত এই তালিকা নিয়ে জনমনে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
সে সময় জানানো হয়, ২০২০ সালের স্বাধীনতা দিবসের আগেই নতুন করে রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রকাশ করা হবে। তালিকায় যাতে কোনো ধরনের ভুল-ত্রুটি না থাকে সেজন্য যাচাই-বাছাই করে এটি প্রকাশ করা হবে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও পৃথকভাবে একটি তালিকা প্রকাশের কথা জানান তখন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই তালিকা প্রকাশে কার্যকর উদ্যোগ নেই কোনো পক্ষ থেকেই।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বুধবার বলেন, রাজাকারের তালিকা তৈরির জন্য জাতীয় সংসদে একটি আইন প্রস্তাব করা আছে। এটি পাশ হলেই তালিকা তৈরি ও প্রকাশ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত আইনি বাধার কারণেই রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা প্রকাশের বিষয়টি গত তিন বছর ধরে আটকে আছে। এ কারণে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধন করে কাজটি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এর অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ বছর ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০২২ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। খসড়া আইনটিতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির বিধান রাখা হয়, যা এর আগে ছিল না।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ প্রসঙ্গে আরও জানান, আইনটি জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনে পাশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, এটি পাশ হলে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরিতে কোনো বাধা থাকবে না।
জাতীয় সংসদের আইন শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০২২ এর খসড়ায় ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, যারা ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যক্রম দিয়ে মানুষ হত্যা বা অত্যাচার করেছেন এবং যারা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন তাদের তালিকা প্রণয়ন ও গেজেট প্রকাশের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করার ক্ষমতা ও দায়িত্ব সংধোশিত আইনে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে দেওয়া হয়েছে।’
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধনের খসড়া তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ওই বছর ২৯ ডিসেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সুপারিশও নেওয়া হয়। ২০২০ সালের মার্চ মাসে আইনের ভাষা পরিমার্জনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষে পাঠানো হয়।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে দুটি সংশোধনী দিয়ে ওই খসড়ার নীতিগত অনুমোদন করা হয়। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য তা গত বছর জুনে মন্ত্রিপরিষদ সভায় পাঠানো হয়। এ বছর ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০২২ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।
প্রায় এক দশক আগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর রাজাকার, আলবদর, আলশাসমসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের বিজয় দিবসের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ১০ হাজার ৭৮৯ জন ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’ একটি প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেন।
কিন্তু ওই তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম আসায় ক্ষোভ আর সমালোচনার প্রেক্ষাপটে সংশোধনের জন্য এটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয় মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে। খোদ সরকারি দলের সদস্যরাই এ নিয়ে তার সমালোচনায় মুখর হন।
সে সময় মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক নতুন করে তালিকা তৈরির কথাও জানান। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে গঠিত একটি উপকমিটি এই তালিকা তৈরি ও প্রকাশের কাজ শুরু করার কথা জানায়।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ৯ আগস্ট রাজাকারের তালিকা তৈরি করতে ছয় সদস্যের উপকমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।
২০২১ সালের বিজয় দিবসের আগেই রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ স্বাধীনতা বিরোধীদের ‘আংশিক’ তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানান কমিটির সভাপতি ও উপকমিটির আহ্বায়ক শাজাহান খান।
২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠক শেষে এ দাবি করে তিনি বলেন, তার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি উপকমিটি এরই মধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। আমরা কিছু তালিকা সংগ্রহ করেছি। আশা করছি আগামী ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে আংশিক তালিকা প্রকাশ করব। পর্যায়ক্রমে আমরা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করব।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন উপকমিটির আহ্বায়ক শাজাহান খান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে তৃণমূল পর্যায় থেকে তালিকা সংগ্রহ করেছি। এই তালিকা সংগ্রহ করার কাজটি অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজটিও চলছে।
তিনি বলেন, রাজাকারদের তালিকা নিয়ে যাতে আবার নতুন করে বিতর্ক তৈরি না হয়-এজন্য আমরা সতর্কতার সঙ্গে কাজটি করছি। যাতে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির নাম এই তালিকায় অসাবধানতাবশত ঢুকে না পড়ে সে দিকটিও বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছি।
শাজাহান খান আরও বলেন, জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০২২ এর খসড়া বিলটি পাশ হওয়ার কথা রয়েছে। বিলটি পাশ হলে রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরি ও প্রকাশে কোনো বাধা থাকবে না।
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কয়েকটি রাজনৈতিক দল পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী। তখন যুদ্ধরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল। আনসার বাহিনীকে এই বাহিনীতে একীভূত করা হয়েছিল।
প্রথমে এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে গঠিত শান্তি কমিটির অধীনে থাকলেও পরে একে আধাসামরিক বাহিনীর স্বীকৃতি দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার।
একইরকম আধাসামরিক বাহিনী ছিল আলবদর বাহিনী ও আলশামস বাহিনী। তবে স্বাধীনতাবিরোধী এই বাহিনীগুলোকে সাধারণ অর্থে রাজাকার বাহিনী হিসেবেই পরিচিত বাংলাদেশে। এসব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থনে ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ ঘটায়।