আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা। এর আগে প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গে তিন দফা সংলাপ করে নির্বাচন কমিশন।
সোমবার (১৮ এপ্রিল) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এদিন বেলা ১১টায় বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধান নির্বাহীসহ সাংবাদিকদের নিয়ে ইসির চতুর্থ ধাপের সংলাপ শুরু হয়।
সংলাপে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল ইসির উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। সেটিই আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম। আপনারা জানেন আপনাদের কাজটা কী? ডানে-বামে কিছুই নেই ভালো নির্বাচন করা ছাড়া। সহিংসতা না ঘটানো নিশ্চিত করা, সবাই যেন নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয় সেটা নিশ্চিত করা। নির্বাচন কমিশন হতভাগা প্রতিষ্ঠান। যারাই হেরেছে তারাই কমিশনকে দোষ দিয়েছে। কাজেই আপনারা হতভাগা প্রতিষ্ঠানে এসেছেন।
তিনি বলেন, আস্থার সংকট দূর করা দরকার। এনআইডি যদি সংশোধন না করেন, তাহলে কিন্তু অসংখ্য মানুষের খুনের দায়ে দায়ী হবেন। প্রার্থীদের হলফনামা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার জন্য আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। সেটা প্রকাশ করা উচিত। তাহলে একজন প্রার্থীর অবস্থান তুলনা করা যায়।
জাগো নিউজের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জিয়াউল হক বলেন, ইভিএমে ভুলত্রুটি দূর করে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। নয়তো জনগণ নির্বাচন ব্যবস্থায় আস্থা ফিরে পাবে না।
একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু বলেন, ৫০ বছর পরও নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত। কখনো কখনো দলগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ইসিকে বিতর্কিত করেছে। এটা একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আপনাদের এটার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। সবচেয়ে ভালো ইসি যাকে আমরা বলি, সেটা হচ্ছে ড. শামসুল হুদা কমিশন। সেই কমিশন বিএনপিকে ভাঙার জন্য মেজর হাফিজের নেতৃত্বাধীন অংশকে ধানের শীষ প্রতীক দিতে চেয়েছিল।
তিনি বলেন, এটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম নির্বাচন কমিশন ছিল। কাজেই পারসেপশন একটা অদ্ভুত খেলা। শামসুল হুদা ও সাখাওয়াত হোসেনের মতো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আর কারও ছিল না। কাউকে নির্বাচনে আনা বা না আনা, দল ভাঙার কাজ তো আপনাদের নয়। চোখ-কান বন্ধ করে সোজা পথে হাঁটেন। বড় দলগুলো না এলে একতরফা হয়ে যায়। এর বাইরে কাউকে আনা বা না আনা আপনাদের কাজ নয়।
নিউজ ২৪-এর নির্বাহী সম্পাদক রাহুল রাহা বলেন, নির্বাচনকালীন মিথ্যা প্রচার, অপপ্রচার রোধে নজরদাবি জরুরি। ভোট নিয়ে আস্থা ফেরাতে বড় দুই দলের মহাসচিব পর্যায়ে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) এমডি আবুল কালাম আজাদ বলেন, কথায় কথায় ইসিকে পদত্যাগের কথা বলা হয়। পদত্যাগে বাহাদুরির কিছু নেই। ভোটে আসা না আসা দলগুলোর নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়। জামাই আদর করে কাউকে ডেকে আনা হবে না।
এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন বলেন, আমরা চাই এমন একটি নির্বাচন হোক, যেখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অংশ নেবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনা কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কি না আমি জানি না। সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপ করার বিষয়টি আরপিওতে নেই। আমরা জানি আপনাদের উদ্দেশ্য ভালো। আপনারা চান একটি ভালো নির্বাচন হোক। আপনারা চেষ্টা করবেন বিএনপি যেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। সে রকম একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোনো নির্বাচন কমিশনই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সবাই বলেছেন যারা পরাজিত হয় তারা নির্বাচনের সমালোচনা করেন। কিন্তু আপনারা অনেকেই বলেছেন রাতে নির্বাচন হয় না। আসলে রাতে নির্বাচন হয় না। রাতে ব্যালটবাক্স ভরে রাখা হয় ব্যালট পেপার দিয়ে। রাতে ভোটের বাক্স ভরে রাখা হয়েছিল। ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে পরের দিন। এগুলোই ঘটেছে বাংলাদেশে। আমরা এই কথাগুলো জেনেশুনেও বলি না, কারণ আমরা বলতে ভয় পাই, লিখতে ভয় পাই।
‘বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কতখানি তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এখন আমার স্বাধীনতা আর নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা যদি একরকম হয় তাহলে আমাদের এখানে ডাকার কোনো মানে হয় না। আমি মনে করি নির্বাচন কমিশন আমার চাইতে স্বাধীন। কমিশন যদি স্বাধীনভাবে কথা বলতে চায়, স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায় তাহলে তাদের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ যথেষ্ট। নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড শক্ত থাকলে সরকারের খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। আপনারা চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবেন। বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের গণমাধ্যম আপনাদের সহায়তা করবে।’
তিনি বলেন, আজ সংলাপে আমার সহকর্মী, বন্ধু, ভাইদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল, আমি কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে আসলাম নাকি। এখানে বিএনপির পক্ষে বক্তব্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য হচ্ছে। গণমাধ্যমেও একই ধরনের বিভক্তি আছে। আপনারা নিশ্চিই সেটি আগের থেকে জানেন। এখন আরও ভালোভাবে জানতে পারবেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে বিভক্তি থাকবে, তবে আপনাদের মধ্যে যেন বিভক্তি না থাকে।
‘বিগত অনেকগুলো কমিশন আমরা দেখেছি নির্বাচন কমিশন আসলে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। সেটি কিন্তু ঠিক নয়, সাংবিধানিকভাবে আপনারা পাঁচজনই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অথবা যেকোনো একজন কথা বলতে পারবেন। কিন্তু এটি যেন প্রধান নির্বাচন কমিশনের কমিশন না হয়।’
নাগরিক টিভির হেড অব নিউজ দীপ আজাদ বলেন, নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, চাইলে সেই ক্ষমতা বলে সুষ্ঠুভাব নির্বাচন করতে পারে। তবে সেই ক্ষমতা তারা ব্যবহার করতে চায় কি না, এটা একটা বড় প্রশ্ন? ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে কে থাকবে পুলিশ নাকি প্রিসাইডিং অফিসার। গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায় যখন পুলিশ ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকে। কাজেই প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, সবাই নির্বাচনে আসবে, সাধারণ মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে। আরেকটি কথা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে এটিই আপনাদের পেশাগত জীবনের শেষ অ্যাসাইনমেন্ট। এরপর হয়তো আর কোনো রাষ্ট্রীয় কাজ পাবেন না। এটি মাথায় রেখে কাজ করলে ভালো কিছু করতে পারবেন।
বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ মাসুদ কামাল বলেন, মূল সংকটটি কোথায় তা ভালো বোঝেন বলেই আপনারা দায়িত্বটা নিয়েছেন। না বুঝলে হয়তো দায়িত্ব নিতেন না। আরও কিছু বোঝার জন্য এই সংলাপ করছেন। নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় সংকট হলো আস্থার সংকট। মানুষ নির্বাচন কমিশনের কথা বিশ্বাস করে না। গত দুটি নির্বাচনে এই বিশ্বাস শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, যদি প্রত্যেক নাগরিককে ভোট দেওয়া নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে বুঝবো আপনি সফল। এ বিষয়টি আপনি অর্জন করতে পারবেন কি না তাই মুখ্য বিষয়।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন এনটিভির বার্তাপ্রধান জহিরুল আলম, চ্যানেল আইয়ের প্রধান বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান, আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক রহমান, একুশে টিভির হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরী, বাংলাভিশনের হেড অব নিউজ আব্দুল হাই সিদ্দিক, মাইটিভির হেড অব নিউজ শেখ নাজমুল হক সৈকত, সময় টিভির হেড অব নিউজ মুজতবা দানিশ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির চিফ নিউজ এডিটর আশিস সৈকত, মাছরাঙা টিভির হেড অব নিউজ রেজোয়ানুল হক রাজা, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, দেশ টিভির চিফ নিউজ এডিটর বোরহানুল হক সম্রাট, ডিবিসি নিউজের সিইও মঞ্জুরুল ইসলাম, গ্লোবাল টিভির এডিটর সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ, যমুনা টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম আহমেদ, স্পাইস টিভির এডিটরিয়াল হেড তুষার আব্দুল্লাহ।