ভাই গোতাবায়াকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীলংকার ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে রীতিমতো নায়ক বনে গিয়েছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। নিয়তির পরিহাস নয়, পরিবারতন্ত্রের দুঃখজনক ও নেতিবাচক পরিণতিতে আজ সেই মাহিন্দাই দ্বীপরাষ্ট্রের ধিকৃত খলনায়ক। ঐতিহাসিক জনরোষে হারিয়েছেন প্রধানমন্ত্রিত্ব, গণলাঞ্চনার হাত থেকে বাঁচতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে পালিয়ে এখন নৌঘাঁটিতে।
পরিবারের বাকি সদস্যদের ভাগ্যও ছুটছে সেদিকেই। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এই দ্বীপের দেশটি সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। খাদ্য ঘাটতি, জ্বালানি সংকট আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল দেশের সাধারণ মানুষ। এক পরিবারের বেশুমার ও বেসামাল দুর্নীতির সুনামিই ডুবিয়েছে দ্বীপটিকে। জনগণের খাদ্যের দাবি শেষমেশ পরিণত হয়েছে রাজাপাকসে ‘পরিবার হটাও’ আন্দোলনে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পরিবারটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্র। রাজাপাকসে পরিবার বিরোধী জ্বলন্ত এই অগ্নিকুণ্ডের উত্তাপে গোতাবায়াসহ বাকি সদস্যরা কতদিন দেশে থাকতে পারেন, সেটাই এখন দেখার পালা।
পরিবারটির উত্থান-পতন : দুই দশক ধরে দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন রাজাপাকসেরা। চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে (১৯৯৪-২০০১)। এরপর একে একে রাজনীতিতে এসেছেন তার অন্য ভাইয়েরা। তার বড় ভাই চামাল এবং চাচাতো বোন নিরুপমাও রাজনীতিতে আছেন। কুমারাতুঙ্গার পর ২০০৫ সালে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাহিন্দা। গোতাবায়াকে নিয়োগ দেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে। দুই ভাই মিলে শ্রীলংকার তামিল টাইগারদের পরাজিত করেন। এই জয়ের মধ্য দিয়ে রাজাপাকসেরা আরও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবারের ঘনিষ্ঠদের বসাতে থাকেন দুই ভাই। রাজাপাকসে পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের রাজনীতিবিদ হচ্ছেন মাহিন্দা, মেজ ভাই গোতাবায়া এবং তাদের বড় ভাই চামাল ও ছোট ভাইবাসিল। চতুর্থ প্রজন্মও এরই মধ্যে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। মাহিন্দা ও চামালের সন্তান নামাল, ইয়োসিথা এবং শশীন্দ্র রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। মিস্টার টেন পার্সেন্ট নামে খ্যাত বাসিল নিজে একজন রাজনৈতিক কৌশলবিদ-যিনি মাহিন্দার অধীনে অর্থনৈতিক বিষয়াদি সামলাতেন। সম্প্রতি তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন। অপরদিকে চামাল পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন। এছাড়া মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি বিমানমন্ত্রী ছিলেন।
দুর্নীতির মহাসুনামি : ২০০৯ সালে শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাজার থেকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এবং পোর্টফোলিও দেশটিতে ঢেলে দেওয়া হয়। এ সময় বড় আকারের অবকাঠামো প্রকল্প যেমন মহাসড়ক, বিমানবন্দর, পদ্ম টাওয়ার নির্মাণের কাজ হাতে নিয়ে পকেট ভারী করেছেন মাহিন্দা। এসব নিয়ে প্রেসিডেন্টের সমালোচনাকারীদের ব্যাপক হুমকি দিয়েছিলেন মাহিন্দা, হত্যা কিংবা গুম করা হয় কয়েকজন সাংবাদিককে। ২০০৫ সালে শুরু হওয়া মাহিন্দার দুর্নীতির ঝাঁপি বন্ধ হয়নি ২০১৯-এ এসেও। পারিবারিক সদস্যদের অর্থনৈতিক লুটপাট ধামাচাপা দিতে আশ্রয় নেন দমন-পীড়ন নীতির। বিশেষ কোনো অভিযোগ ছাড়াই সমালোচনাকারীদের গ্রেফতার করেন।
শ্রীলংকায় পরিবারতন্ত্রের সম্ভাব্য অবসান : রাজাপাকসে রাজবংশের চার ভাই প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অন্য দুজন মন্ত্রীর দৌরাত্ম্যে চুপসে গেছে গোটা শ্রীলংকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। আর এরই সুযোগ নিয়ে পরিবারটির নজিরবিহীন দুর্নীতি দেশটিকে পরিণত করেছে ‘তলাবিহীন ঝুড়িতে’। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট ২০২১ অনুযায়ী তাদের অবস্থান ১২১। আর ব্যাপক দুর্নীতির কারণেই যেন নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়লেন পরিবারের সদস্যরা। দুর্নীতির চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়েছে দেশটির অর্থনীতি। তাতেই যেন নিশ্চিত হয়ে যায় দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক পরিবারের দাপটের অবসান।