ঝিনাইদহে সড়কে থেমে থাকা ট্রাকে মোটরসাইকেলের ধাক্কা লেগে সরকারি ভেটেরিনারি কলেজের তিন ছাত্র নিহত হন গত শুক্রবার (৭ অক্টোবর)। ওই দিন রাতে প্রতিপক্ষের ধাওয়া খেয়ে পালাতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তবে ঘটনার দুই দিন পর নিহতদের স্বজন ও আহতদের দাবি, তিন জনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডকে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে প্রচার করছে ছাত্রলীগের এক নেতা ও তার অনুসারীরা।
এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত সাজিবুল ইসলাম গত শনিবার ভেটেরিনারি কলেজের সাবেক ছাত্র ও জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ফাহিম হাসান সনিকে প্রধান আসামি করে আট জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলায় দুই জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- নয়ন মিয়া ও সংগ্রাম জোয়ার্দ্দার।
সংঘর্ষের ঘটনায় ফাহিমসহ সাত নেতাকে জেলা ছাত্রলীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে তিন জনকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগে কোনও মামলা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
জানা গেছে, গত ৭ অক্টোবর রাতে সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এতে আহত হন আট জন। সংঘর্ষ চলাকালে প্রতিপক্ষের ধাওয়া খেয়ে পালানোর সময় সড়কে থেমে থাকা মালবাহী ট্রাকে ধাক্কা লেগে কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি সাইদুর রহমান মুরাদ (২৫), ওই কলেজের শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম (২৩) ও সমরেশ বিশ্বাস (২২) মারা যান। এরপর তাদের মৃত্যু ‘সড়ক দুর্ঘটনায় হয়েছে’ বলে প্রচার করা হয়। তবে মুরাদের স্বজনদের অভিযোগ, তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
তারা বলছেন, ‘এটা সড়ক দুর্ঘটনা ছিল না। ভেটেনারি কলেজের দুই ছাত্র ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাদেরকেও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে। তারা জবানবন্দি দিয়েছেন।’
আহত ছাত্রলীগ কর্মী ও ভেটেরিনারি কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস সাজিবুল ইসলাম এবং আরেক ছাত্র নুর হোসেন ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের দাবি, জেলা ছাত্রলীগ নেতা ফাহিম ও তার সমর্থকরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
সাজিবুল ও নুর বলেন, ‘সেদিন রাতে ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিলাম। এ সময় তিন-চারটি মোটরসাইকেলে কয়েকজন এসে পেছন থেকে হঠাৎ করে রামদা বের করে আঘাত করতে থাকে। আমি বাঁচার জন্য পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। আমাকে মেরে ফেলার জন্য ওরাও পুকুরে ঝাঁপ দেয়। মুরাদ ভাইরা তখন এগিয়ে চলে যান। এ সময় তারা মুরাদ ভাইকে হত্যার জন্য ওই গাড়ি ফলো করে কোপ দিতে থাকে। ওই সময় আর মোটরসাইকেল কন্ট্রোল করতে পারেননি। এ সময় হয়েতো ট্রাকের সঙ্গে মোটরসাইকেল ধাক্কা খেয়েছে।’
সাইদুর রহমান মুরাদের চাচা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তিন ভাইয়ের মধ্যে মুরাদ দ্বিতীয়। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। বাড়িতে এক ভাই, বোন ও মা রয়েছে। বাবা মারা গেছে অনেক আগে। তার পড়াশোনা ও সংসারের হাল ধরেন মা। ভাইয়ের সঙ্গে মিলে বাড়িতে একটি গরুর খামার গড়ে তুলেছিল মুরাদ। ভালোভাবেই চলছিল সংসার। কিন্তু সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলো। মুরাদকে কুপিয়ে হত্যা করে সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হলো। আমরা এই ঘটনায় সঠিক তদন্ত চাই, দোষীদের বিচার চাই।’
সমরেশ বিশ্বাসের মামাতো ভাই চণ্ডিদাস রায় বলেন, ‘সমরেশরা দুই ভাই দুই বোন। তাদের বাবা চন্দ্র বিশ্বাস কৃষক। ছেলেকে ডাক্তার হতে উৎসাহ দিয়েছিলেন তিনি। সমরেশের মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে পুরো পরিবার।’
ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মো. সোহেল রানা জানান, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। তারপরও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসলে বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যাবে। ওই রাতের সংঘর্ষ ও আহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলায় দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ওসি আরও জানান, ওই রাতে সংঘর্ষ হয়েছে এটাও ঠিক। আবার নিহতরা মোটরসাইকেল দিয়ে ট্রাকে ধাক্কা দিয়েছে এটাও ঠিক। এখন ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে জানা যাবে এটি হত্যাকাণ্ড নাকি দুর্ঘটনা।
জানা গেছে, ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজে ডিগ্রি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন নিয়ে কলেজের জিএস সজিব ও জেলা ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি ফাহিমের মধ্যে বিরোধ চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ অক্টোবর রাতে সংঘর্ষ হয়। প্রতিপক্ষের ধাওয়া খেয়ে মোটরসাইকেলে পালাতে গিয়ে ট্রাকে ধাক্কা লেগে তিন জন নিহত হন।
নিহতদের মধ্যে সাইদুর রহমান মুরাদ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কুশোবাড়ে গ্রামের বাদশা বিশ্বাসের ছেলে, তৌহিদুল কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার বলেশ্বরপুর গ্রামের মৃত গোলাম মোস্তফার ছেলে এবং সমরেশ যশোরের মনিরামপুর উপজেলার পাড়াদিয়া গ্রামের রাখাল চন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে ও ভেটেরিনারি কলেজের শিক্ষার্থী।