খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, রোজার শুরু থেকেই তারা চাহিদা অনুযায়ী সয়াবিন তেল পাচ্ছেন না। পাঁচ লিটার তেলের বোতল পাওয়া যায় না। এক ও দুই লিটার অল্প পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে, তাও দাম বেশি।
বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুল মালেক। মুগদা বাজার থেকে মাসের সদাই করেন। ঈদের পরদিন বুধবার সয়াবিন তেল কিনতে বাজারে যান। কয়েকটি দোকান ঘুরেছেন কিন্তু তেল পাননি তিনি। পরে এক দোকানে পান এক লিটারের পুষ্টি তেলের বোতল। দোকানি দাম চেয়েছে ২০০ টাকা। উপায় না থাকায় ২০০ টাকাতেই এক লিটার তেল কিনে বাড়ি ফিরেছেন।
একই অবস্থা রাজধানীর সেগুনবাগিচা বাজারেও। সেখানে বোতলজাত সয়াবিন তেল পাননি এমন এক ক্রেতা জুনায়েদ আহমেদ বলেন, দোকানিকে তেল না থাকার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে বলল, তেল তো পাওয়া যায় না। অর্ডার করলে ডিলাররা দেয় না। যাও দিতে চায় দাম বেশি। এক লিটার ২০০ টাকার কম বিক্রি করা যায় না।
পরে তিনি পাশের সুপার শপ আগোরায় গিয়ে দেখেন সেখানেও তেল নেই। দায়িত্বরত কর্মী জানান, ঈদের আগেই তেল শেষ হয়ে গেছে।
জুনায়েদ বলেন, অবাক হলাম। এতোগুলো দোকান ঘুরলাম কারো কাছে তেল নেই। তাহলে তেল গেল কোথায়? পরে মালিবাগ বাজারে গিয়ে দুই লিটার তেলের বোতল কিনলাম ৩৯০ টাকায়। লিটার ১৯৫ টাকা পড়ল।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, রোজার শুরু থেকেই তারা চাহিদা অনুযায়ী সয়াবিন তেল পাচ্ছেন না। পাঁচ লিটার তেলের বোতল পাওয়া যায় না। এক ও দুই লিটার অল্প পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে, তাও দাম বেশি।
তেলের দাম জানতে চাইলে মুদি ব্যবসায়ী আল আমিন বলেন, ভাই তেলের দাম অনেক বেশি। পাওয়াই যায় না। পাঁচ লিটারের কোনো তেলের বোতল নেই। কারণ রমজানের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডিলাররা পাঁচ লিটারের কোনো তেলের বোতল দেয়নি। এক-দুই লিটার যা দিচ্ছে, ২০টা অর্ডার দিলে ৫টা দেয়। তারপরও বেশি রেট। খুচরা এক লিটারের তেল এখন ১৯০ থেকে ২০০ টাকা আর খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি করছি ২১০ টাকায়।
অনেকের অভিযোগ, এখন যাদের কাছে তেল মজুত আছে তারা সয়াবিন তেলের বোতলের মুখ খুলে খোলা আকারে বিক্রি করছে। কারণ এতে লাভ বেশি। এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরকারি রেট ১৬০ টাকা। কিন্তু কেজি হিসাবে ধরলে (এক কেজি সমান ১.০৯ লিটার) তা ১৭৫ টাকা পড়ে। কিন্তু বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। তাই বেশি লাভের আশায় বোতলের তেল খুলে খোলা বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
বিষয়টি স্বীকার করে মালিবাগের খুচরা ব্যবসায়ী আলমগীর জানান, এক লিটার বোতলের গায়ে রেট ১৬০ টাকা, কিন্তু কেনা পড়ে ১৮০ টাকার ওপরে। ক্রেতা গায়ের রেট দিতে চায়, এ নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়। তাই সবচেয়ে ভালো, বোতল খুলে তেল বিক্রি করা।
তেলের দাম বেশি থাকার কারণ জানতে চাইলে দেশের অন্যতম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (কর্পোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, সরকারের নির্ধারিত দামেই আমরা চাহিদা অনুযায়ী মিল থেকে ভোজ্যতেল সরবরাহ করছি। কোনো সংকট নেই। বিশ্ব বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে। তাই আমাদের এখানেও বাড়বে এমন ভাবনায় ডিলার ও খুচরা দোকানিরা তেল বিক্রি না করে মজুত করছেন। পরে বেশি দামে বিক্রি করবেন এই আশায় আছেন তারা। এজন্যই তারা তেলের সরবরাহের ‘সংকট’ আছে বলে অজুহাত দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়তি। বাংলাদেশেও এ দাম সমন্বয় করতে হবে। ঈদ শেষ হয়েছে, এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা বৈঠকে বসব। সেখানে দাম সমন্বয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক থাকলে তেলের এ সংকট দেখা দিত না। প্রতিটি মার্কেটে ডিস্ট্রিবিউটর দিয়ে রেখেছে, তারা কি চাহিদা অনুযায়ী তেল পেয়েছে? তাহলে কীভাবে তারা দাবি করছে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক আছে? মিলগুলো অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেরা ভালো থাকতে চাচ্ছে।
তিনি বলেন, তেলের মূল সমস্যা হলো, সরকার রমজান মাসে ১৬০ টাকা লিটার দাম বেঁধে দিয়েছিল। এ দামে মিল মালিকরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারা আরও বেশি দামে তেল বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার রোজায় তা করতে দেয়নি। তাই তারা সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বাজারে সংকট তৈরি করেছে। এখন বিভিন্ন পক্ষের ওপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। সরকার যদি ওই সময় তেলের দাম বাড়িয়ে দিত তাহলে দাম বেশি হলেও এই সংকট তৈরি হতো না।
ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের এ নেতা আরও বলেন, পাইকারি বাজারে বেশিরভাগ ভোজ্যতেল বাল্ক আকারে বিক্রি হয়। কিন্তু অধিকাংশ মিল বাল্কে তেল বিক্রি করেনি। ঢাকায় বাল্কে তেল বিক্রি করেছে তিনটি মিল। এর মধ্যে সিটি, মেঘনা, টি কে গ্রুপ আর চট্টগ্রামে সাপ্লাই দিয়েছে এস আলম আর সিটি গ্রুপ। অন্য যেসব ভোজ্যতেলের প্রতিষ্ঠান আছে যেমন, রূপচাঁদা ও বসুন্ধরাসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, তারা তেল সরবরাহ করেনি। আর যারা দিয়েছে তারা সর্বনিম্ন সরবরাহ করেছে। তাহলে বাজারে তেলের সংকট হবে না কেন? আমরা খোঁজ নিয়েছি তাদের কাছে (মিলে) তেলের কোনো সংকট নেই। সরবরাহ বাড়ালেই বাজার ঠিক হয়ে যাবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, বাজারে সয়াবিন তেল সংকট নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, মিলগুলো সরবরাহ ঠিক রাখলেও ডিলার, পাইকার ও খুচরা দোকানিরা চাহিদা অনুযায়ী তেল বিক্রি করছেন না। তারা মজুত করে বাজারে সংকট সৃষ্টি করছেন। আমারা বিভিন্ন অভিযানে গিয়ে এর প্রমাণ পেয়েছি। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে তেল মজুত করার দায়ে জরিমানা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ঈদ শেষ হয়েছে, এখন আমরা মিল, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতাদের ডাকব। তারা কেন সংকট সৃষ্টি করেছেন জানতে চাওয়া হবে। এছাড়া আমাদের অভিযান চলমান থাকবে। যারাই অবৈধ মজুতের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে; পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।