দুর্নীতি দমন কমিশনে ঘুস-দুর্নীতির অভিযোগ জমার পরও ছাড় পাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে জমা অভিযোগ আমলেই নিচ্ছে না যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক)। কিছু অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা মিললেও মামলার সুপারিশ কার্যকর হচ্ছে না। এজন্য দুটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন খোদ দুদক কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সংস্থাটির শীর্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পদে আছেন প্রেষণে যোগ দেওয়া কর্মকর্তারা। তাদের মধ্যে তিনজনই যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত তাদের কারণে তদন্ত ও অনুসন্ধান কর্মকর্তারা নানামুখী চাপে থাকেন। এ কারণে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দূরের কথা, আইনের মুখোমুখি করতে পারছে না দুদক।
ঘুস-দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত চলমান-এমন অনেকেই প্রেষণে দুদকে যোগ দিয়েছেন। এরপর প্রভাব দিয়ে নিজের ও স্বার্থসংশ্লিষ্টদের ফাইল ধামাচাপা দিয়েছেন। বিশেষ একটি ক্যাডার সার্ভিসের কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের নজির স্থাপনে দুদকের ভেতরে-বাইরে চলছে নানা গুঞ্জন। এ নিয়ে দুদক কর্মকর্তাদের মধ্যেও আছে চাপা ক্ষোভ। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে দুদকের গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগদানের বিষয় নিয়ে কথা হয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সরষের মধ্যে ভূতের’ কারণে দুদকের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুদকে পদায়ন করা হচ্ছে। সরকারের মধ্যে একাংশ আছে, যারা চায় না দুদক কার্যকর হোক। তারাই এ ধরনের কর্মকর্তাদের দুদকে পদায়ন করছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ধামাচাপা দিতে চাইবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু চাইলেই সেটা তারা করতে পারবে কেন? তাহলে শীর্ষ কর্মকর্তারা কী করছেন? তারা কি এটা দেখছেন না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বগোত্রীয়দের ওপর যে কারও আনুগত্য থাকবেই। এখনে যাচাই-বাছাই কমিটির সব সদস্যই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। সেক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত কম হবেই। এটা চলতে থাকলে দুদক কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাঁড়াতে পারবে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল। তিনি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্তের দায়িত্বে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দশমিক ২২ একর খাসজমি বন্দোবস্তসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে দুদক। কিন্তু দুদকের নোয়াখালী অফিসের এক কর্মকর্তাকে চাপ দিয়ে তিনি অভিযোগ থেকে রেহাই পান বলে অভিযোগ আছে।
এ সংক্রান্ত মামলায় আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘প্রকৃতই ভূমিহীন কি না, তা যাচাই করতে যদি ভূমি অফিস অক্ষম হয়ে থাকে তাহলে রাষ্ট্রের ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য ভূমি অফিস নামক একটি অফিস রাখার কী যৌক্তিকতা, তা অবশ্যই বড় একটি প্রশ্ন হিসাবে দেখা দেয়।’ তদন্তে ত্রুটি আছে উল্লেখ করে আদালত মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন। মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল ২০১৭ সালের ১ আগস্ট দুদকের প্রধান কার্যালয়ে উপপরিচালক হিসাবে প্রেষণে যোগ দেন। পদোন্নতি পেয়ে তিনি এখন পরিচালক। ৩ বছর প্রেষণকালের জায়গায় ৫ বছরের বেশি সময় তিনি দুদকেই আছেন। লক্ষ্মীপুরের ভূমিসংক্রান্ত ওই দুর্নীতি মামলা পুনঃতদন্তে আদালতের নির্দেশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযোগ আছে, এর পেছনে তিনি প্রভাব খাটাচ্ছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘ভূমিহীনদের খাসজমি বন্দোবস্তের বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বড় ভূমিকা থাকে। কমলনগরে আমি সুনামের সঙ্গেই কাজ করেছি। আদালতের পর্যবেক্ষণ বা পুনঃতদন্তের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। তিনি বলেন, ‘আমি রাষ্ট্রের চাকরি করি। কর্তৃপক্ষ যখন যেখানে চাইবে, যতদিন রাখবে, সেখানেই দায়িত্ব পালন করব।’
২০১৯ সালে রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন মোহাম্মদ আকতার হোসেন আজাদ। তিনি দুদকের পরিচালক পদে যোগ দেন ২০২০ সালে। এখানে যোগদানের আগেই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির একটি অভিযোগের অনুসন্ধান চলছিল। রংপুর সিটি করপোরেশনে থাকার সময় তার এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এমদাদ হোসেনের বিরুদ্ধে টেন্ডার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের অনুসন্ধানে সত্যতা বেরিয়ে এলে মামলার প্রস্তুতি নেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। তখন প্রভাব বিস্তার করে তদন্ত কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আক্তার হোসেন ও এমদাদ হোসেনকে বাদ দিয়ে মামলা হয়। মামলায় ‘ফাঁসিয়ে’ দেওয়া হয় রংপুর সিটি করপোরেশনে অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মরত সাবেক কর্মচারী আদর রহমানকে।
তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলে বাঁধে জট। প্রধান অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে আদর রহমানকে আসামি করার বিষয়ে আদালত জানতে চান। গত ১৪ মার্চ শুনানি চলাকালে আদালত ও আইনজীবীদের জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে না পেরে পুনঃতদন্তের আবেদন জানান দুদক কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এখনো দুদকে বহাল থাকায় পুনঃতদন্তের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে আশঙ্কার কথা জানান ভুক্তভোগী আদর রহমান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোহাম্মদ আকতার হোসেন আজাদ বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা রিপোর্ট দিয়েছেন। পরে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মামলা হয়। তদন্ত কর্মকর্তাই এ বিষয়ে ভালো জানেন। এখানে প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ নেই।
জানা যায়, এলএ কেসের একটি অভিযোগে হবিগঞ্জের সাবেক এডিসি (রাজস্ব) দীলিপ কুমার বণিকের (বর্তমানে অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পিইডিপি-৪, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর) বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমোদন দিয়েছিল কমিশন। কিন্তু সেটা কার্যকর হয়নি। হিয়ারিং নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী ছিলেন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন খান। তার বিরুদ্ধে সরকারি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে মামলার সুপারিশ করেছিল তদন্তকারী। কিন্তু মামলা না করে হিয়ারিং নিয়ে তাকেও অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়। দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তকালে তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব।
জানতে চাইলে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ অস্বীকার করে দীলিপ কুমার বলেন, ‘আমরা কাগজপত্র দেখিয়েছি। দুদকের ফুল বেঞ্চ শুনানি করেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে।’ আর মো. রুহুল আমিন খান বলেন, ‘প্রাথমিক রিপোর্টে মামলার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ওপর লেভেল থেকে তদন্ত করে কিছু পায়নি। পরে হিয়ারিং নিয়ে দুদকই সব নিষ্পত্তি করেছে।’
এছাড়াও বনানীর এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অনুসন্ধান শেষে ভবনের অবৈধ অংশের নির্মাণের পেছনে দায়ীদের চিহ্নিত করে মামলা করে দুদক। মামলায় আসামিদের একজন ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্য (অ্যাস্টেট শাখা) রেজাউল করিম তরফদার। কিন্ত হঠাৎ করেই দেখা যায় অভিযোগপত্র থেকে রেজাউল করিমের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার মেয়েজামাই মো. রেজানুর রহমান দুদকের মহাপরিচালক (যুগ্মসচিব) তদন্ত-১ পদে আসীন।
জানতে চাইলে রেজানুর রহমান বলেন, ‘আমি দুদকে আসার আগে মামলায় তাকে (রেজাউল করিম তরফদার) আসামি করা হয়েছিল। অভিযোগপত্র থেকে তার নাম কীভাবে বাদ গেছে সেটা আমার বলার বিষয় নয়। মামলার আইও এটা বলতে পারবেন।’
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, একাধিক মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মো. ফয়জুর রহমান চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে সরকারি ভূমি বন্দোবস্তসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলা ছিল। ময়মনসিংহ শহরে তার বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান করছিল দুদক। এ অবস্থায় ২০১০ সালে তিনি সংস্থাটির সচিব পদে যোগ দেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যেই তার বিরুদ্ধে চলমান মামলা ও আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান নিস্পত্তি করা হয়। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন। এ ব্যাপারে জানতে মো. ফয়জুর রহমান চৌধুরীর মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
রাজশাহীতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক সহকারী কমিশনারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এখানে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধানে তার ২টি টিন নম্বর ও অবৈধ ৩ কোটি টাকা আছে, এমন তথ্য পাওয়া গেলে মামলার সুপারিশ করা হয়। এরপরও ফাইলটি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। সরকারের অনুমোদন ছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কেনার অভিযোগ জমা পড়েছিল এক উপসচিবের বিরুদ্ধে। তিনি চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দায়িত্বও পালন করেন। কিন্ত রহস্যজনক কারণে যাচাই-বাছাই কমিটি এ অভিযোগ আমলে নেয়নি। কক্সবাজার সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) বর্তমানে লন্ডনে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত, তার বিরুদ্ধে ঘুস গ্রহণ অভিযোগ ওঠে। ঘুস বাবদ বাদীর জমি নিজ নামে রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে কতিপয় কর্মকর্তার দুদকে যোগদানের বিষয়ে কথা হয় সংস্থাটির সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতির অভিযোগ আছে-এমন কোনো কর্মকর্তা দুদকে যোগ দেননি। আগে এমন কোনো কর্মকর্তা যোগ দিয়ে নিজেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কিংবা তদন্তের ফাইল নথিভুক্ত করেছেন বলেও আমার জানা নেই। যদি এ ধরনের সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে তাহলে সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে কাউকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপে ১৫ দিনের মধ্যে একটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বাধ্য হয়েছেন এক তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত ওই প্রতিবেদন গ্রহণও করেছে। কিন্তু দুদকই আবার ওই তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে-কেন মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এক কর্মকর্তা তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, প্রভাবশালীদের চাপে তিনি একটি মামলায় ৫ আসামির মধ্যে দুজনকে বাদ দিয়ে ৩ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র জমা দেন। কিন্তু দুই আসামিকে বাদ দেওয়ায় আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেনি। উল্টো তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা তলব করে। তখন দুদকের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা তদন্তকারীর ওপরই সব দায় চাপান।