চাকরি করেন নাইট গার্ড কাম ঝাড়ুদার পদে। তাও আবার মাস্টাররোলে। পান মাত্র ৬০ টাকা মজুরি (দিন হাজিরা)। নাইট গার্ড হলে কী হবে-তিনি জমি কিনেছেন, বিশাল পাকা বাড়ি করেছেন। অফিস চলাকালে সব ক্ষমতা যেন তার হাতেই ন্যস্ত। তার ইচ্ছার বাইরে গেলে জমি রেজিস্ট্রি হয় না।
এমন চতুর ব্যক্তিটি হলেন মহেশপুর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের নাইট গার্ড তরিকুল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কোনো লাভ হয় না। বরং তার ভয়ে তটস্থ থাকেন অফিসের কর্মকর্তারা ও সাধারণ মানুষ। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়-২০০০ সালের ১৯ অক্টোবর তরিকুলকে মহেশপুর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে নাইট গার্ড কাম ঝাড়ুদার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দৈনিক ৬০ টাকা মজুরি (হাজিরা) হিসাবে প্রতি মাসে তিনি ১ হাজার ৮০০ টাকা পান। অনুসন্ধানে জানা যায়-এছাড়া তার কোনো বৈধ আয় নেই। তবে ঘুস বাণিজ্যে সহায়তা করে তিনি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
অফিসের ধার্য ঘুসের টাকা আদায় করার দায়িত্ব তার। কথিত আছে-সাবরেজিস্ট্রার না থাকলেও তরিকুল দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে পারেন! তার ইচ্ছার বাইরে গেলে জমি রেজিস্ট্রি করা যায় না। এজন্য ধার্য ঘুসের চেয়ে তাকে বাড়তি টাকা দিতে হয়। তার কাছে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, দলিল লেখকরাও জিম্মি।
জানা গেছে, মহেশপুর উপজেলার নেপা ইউনিয়নের সেজিয়া গ্রামের কারিকরপাড়ার রবিউল ইসলামের ছেলে তরিকুল। ষাটের দশকে ভারত থেকে তার বাবা রবিউল ইসলাম সপরিবারে এ গ্রামে চলে আসেন। তিনি কামার হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রায় ২৫ বছর আগে তিনি মারা যান। তরিকুলরা নয় ভাই-বোন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার তিন ভাই ওয়েলডিং মিস্ত্রির কাজ করেন। গ্রাম ছেড়ে মহেশপুর শহরে আলিশান বাড়ি নির্মাণ করে তরিকুল বসবাস করছেন।
সম্প্রতি সাবরেজিস্ট্রার অফিসে তরিকুলকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকা তরিকুল হঠাৎ ক্যামেরা দেখে হকচকিয়ে যান। এ সময় সেখানে মহেশপুর ‘একতা’ দলিল লেখক সমিতির কয়েকজন সদস্যও ছিলেন। এদিন সাবরেজিস্ট্রারের উপস্থিতিতে তরিকুলের সঙ্গে কথা হয়। তরিকুলের কাছে অঢেল সম্পত্তি এবং ঘুস বাণিজ্যে সহায়তা করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি জানান, ‘আমি কোনো অন্যায় কাজ করি না। দিনের বেলায় স্যারের (সাবরেজিস্ট্রার) কাজগুলো করে দিই।’
কী কাজ করে দেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এত প্রশ্ন করবেন না, আমিও একজন সাংবাদিক।’ অপর প্রশ্নের জবাবে তরিকুল জানান, তার ইনকাম ট্যাক্স ফাইল নেই তো কী হয়েছে? ছোট ভাইকে বিদেশ পাঠানোর সময় কিছু টাকা দিয়েছিলাম। ওই টাকার বিনিময়ে সে হেবা দলিল মাধ্যমে কিছু জমি দিয়েছে। চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করারও দাবি করেন তিনি। সাবরেজিস্ট্রার বলেন, আপন ভাই হেবা দলিলের বিনিময়ে তরিকুলকে জমি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সাবরেজিস্ট্রার হিসাবে তার কিছুই করার নেই। দিনের বেলায় অফিসে কী কাজ করেন তরিকুল-এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি সাবরেজিস্ট্রার।
অনুসন্ধানে তরিকুলের নামে রেজিস্ট্রি করা ছয়টি দলিল যুগান্তরের হাতে এসেছে। ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর ছয়টি দলিলে (৯৩২৬, ৯৩২৭, ৯৩২৮, ৯৩২৯, ৯৩৩০, ৯৩৩১) মহেশপুর পৌরসভা এলাকাসহ বিভিন্ন মৌজার ৩৮৪.৭৫ শতক জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। এসব জমির দাম (দলিলে উল্লেখ) ৬৮ লাখ ১০ হাজার টাকা।
তরিকুলের মেজভাই জুলফিকার আলী জানান, চতুর্থ ভাই শফিকুল ইসলামের কাছ থেকে তরিকুল জমি কিনেছেন। রাজস্ব ফাঁকি দিতে তরিকুল হেবা দলিল করেছেন। কারণ এ দলিলে রেজিস্ট্রি খরচ অনেক কম। বেশ কিছুদিন উমানে ছিলেন চতুর্থ ভাই শফিকুল। এ সুযোগে বেনামে (শফিকুলের নামে) জমি কিনেন তরিকুল। এরপর সেসব জমি তিনি হেবা করে নেন।
তরিকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ-যিনিই সাবরেজিস্ট্রার হিসাবে এ অফিসে আসেন তিনিই তরিকুলের জাদুর কাঠির কাছে মাথা নত করেন। প্রত্যক্ষভাবে তাকে সমর্থন করেন। দলিল লেখক সমিতির নেতাদের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে।
রাতে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব যার ওপর তাকে দিয়ে দিনের বেলায় অফিসে কী কাজ করানো হয়-এমন প্রশ্নে জেলা রেজিস্ট্রার আসাদুল ইসলাম জানান-এ নিয়ে আগেও কয়েক দফায় তদন্ত হয়েছে। কিন্তু কেউ সাক্ষ্য দেয়নি। তিনি আরও বলেন, সর্বোচ্চ পর্যায় (আইজিআর) থেকে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ৬০ টাকার নাইড গার্ডের বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই।