তিন দিনব্যাপী রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী স্মৃতি মিলনায়তনে শুরু হতে যাচ্ছে ডিসি সম্মেলন ২০২৫। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার তেজগাঁও কার্যালয় থেকে যুক্ত থাকবেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। এবার ডিসিরা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ১ হাজার ২০০-এর বেশি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদের মাঠ প্রশাসন বিভাগে। এসব প্রস্তাবনা থেকে বাছাই করা হচ্ছে সম্মেলনে আলোচনার এজেন্ডা।
রোববার(১৬ ফেব্রুয়ারি) ডিসি সম্মেলন বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর ডিসিদের বাঁধ ভেঙে গেছে। মাঠপর্যায়ের চাওয়া-পাওয়া ও করণীয় নিয়ে রেকর্ডসংখ্যক প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবনায় তারা যে দাবিদাওয়া করেছেন সেগুলো মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিশ্লেষণ করে দেখছে। এবার যেহেতু রাজনৈতিক সরকার নেই তাই ডিসিরা নিজেদের সব ধরনের বক্তব্য নির্ভয়ে পাঠিয়েছেন।
ডিসি সম্মেলন উপলক্ষে বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের কাছ থেকে ১ হাজার ২৪৫টি প্রস্তাব জমা পড়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এর মধ্যে কার্যপত্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ৩৫৩টি প্রস্তাবের ওপর সম্মেলনে আলোচনা হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ দ্বিমত করায় এবং আগের ডিসি সম্মেলনে উপস্থাপিত হওয়ায় অনেক প্রস্তাব কার্যপত্রে রাখা হয়নি।
তারা জানান, এবারের সম্মেলন হবে একটু ভিন্ন ধরনের। শুধু প্রস্তাবনা আর নির্দেশনা দিয়েই আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে না। এবারের টার্গেট সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সেই নির্বাচন যেন স্বস্তির হয় সেটিই প্রাধান্য পাবে আলোচনায়। ডিসিদের নির্বাচনমুখী আয়োজনের পথ দেখানো হবে এ সম্মেলনে।
ডিসিরা কী কী প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডিসিরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের সহায়তা চেয়েছে। যেহেতু অনেক বড় একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরকারকে দেশ পরিচালনা করতে হচ্ছে। ডিসিরা চান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তা অব্যাহত থাকুক। রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আনতে সশস্ত্র বাহিনী মাঠে থাকলে জনগণ আশ্বস্ত হবে বলে মত দিয়েছেন ডিসিরা।
এবার ডিসি সম্মেলনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে ৩৪টি কার্য-অধিবেশন হবে। কার্য-অধিবেশনগুলো ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে কার্য-অধিবেশন এবং সমাপনী অধিবেশন সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নবনির্মিত ভবনে হবে।
এ ব্যাপারে সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম শহীদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডিসিদের প্রস্তাবনা বিবেচনায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা সরকারের বিবেচনা করা উচিত। যে ধরনের মবক্রেসি চলছে সেখানে অবশ্যই সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী নির্বাচন নির্বিঘ্নে, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর করতে হলে আইনশৃঙ্খলার অভূতপূর্ব উন্নয়ন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই সেনাবাহিনী লাগবে।’
ডিসিদের ফোকাস থাকবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া। সেজন্য যখনই কারসাজি করে পণ্য বাজার থেকে সরানো হবে তখন জেলা প্রশাসন সেই দ্রব্য বাজারজাত করবে। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মজুদ ও বরাদ্দ থাকবে। ডিসেম্বর নাগাদ জাতীয় নির্বাচন হতে পারে এমন প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে সরকারের সব বিভাগ। কর্মকর্তারা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সিগন্যাল দিয়েছেন। সুতরাং নির্বাচনমুখী প্রশাসন হবে। তবে নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সেজন্য নির্বাচনের আগে আরও এক দফা ডিসি পরিবর্তন করা হবে। কোথাও কোথাও নতুন ডিসি দেওয়া হবে। কোথাও কোথাও বদল আনা হবে। সেটাই পরিকল্পনা। সেসব প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
এবার ডিসি সম্মেলনে আলোচিত হবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরি, আবাসনের ব্যবস্থার প্রস্তাবনা। গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে গঠিত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ সরকার থেকে ১০০ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি বরাদ্দ প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। এ কাজ ডিসিরা বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। এর অগ্রগতি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে এ সম্মেলনে।
আসন্ন রোজার মাসে অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ, মব ট্রায়াল ঠেকানো, চুরি-ডাকাতি-সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত করতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব আলোচিত হবে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের প্রস্তাবও এবারের সম্মেলনে উঠতে পারে। ভূমি ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণরোধ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম জোরদার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম, স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার, ই-গভর্ন্যান্স, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও সমন্বয়ের ব্যাপারে আলোচনা হবে।
কার্য-অধিবেশনগুলোতে সভাপতিত্ব করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আবদুর রশীদ। সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মুক্ত আলোচনাসহ তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গেও মতবিনিময় করবেন ডিসিরা। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে ডিসিদের কার্য-অধিবেশন, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ, স্পিকারের দায়িত্ব পালন করা আইন উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও একটি সমাপনী অনুষ্ঠান এবং সংস্কার কমিশনের কমিটির সঙ্গে ডিসিদের বৈঠক রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হবে এসব বৈঠক।
গত বছর ডিসি সম্মেলনে ১১৯টি স্বল্পমেয়াদি, ১৯২টি মধ্যমেয়াদি আর ৭০টি দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৩৮১টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ২০২৪ সালে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ৬৪ শতাংশ, মধ্যমেয়াদি ৪০ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদি ৩৬ শতাংশ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে। মোট বাস্তবায়নের হার ৪৬ শতাংশ। গড়ে ৭৫ শতাংশ সিদ্ধান্ত প্রতি বছর বাস্তবায়ন হলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে গত বছর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হার কমেছে বলে মন্ত্রিপরিষদের এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।