প্রতিবছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে সনাতন ধর্মের মানুষ বিভিন্ন নদ-নদীতে স্নান করে থাকেন। ধর্মীয় বিশ্বাস, এই পুণ্য স্নানে ব্রহ্মার সন্তুষ্টি লাভ ও পাপমোচন হয়। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এই পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিপুল সংখ্যক সনাতনীদের উপস্থিতিসহ নানা ধর্মীয় উপাচার, মেলা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাই এই আনুষ্ঠানিকতা ‘অষ্টমীর স্নান উৎসব’ নামে অবিহিত।
শনিবার (৫ এপ্রিল) সারাদেশে আনন্দোৎসবে অষ্টমীর স্নান উদযাপিত হচ্ছে। সনাতনীদের সরব উপস্থিতির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দারা নজরদারি করছেন। নদীতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে বিভিন্ন জায়গায় ফায়ার সার্ভিসের উপস্থিতিও দেখা গেছে। আয়োজকরা বলছেন, এবার অষ্টমীর স্নান ছুটির দিনে হওয়ায় মানুষের ভিড় অনেক বেশি।
শুক্ল তিথি অনুযায়ী শনিবার ভোর চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টা স্নানের উত্তম সময়। আর উত্তম লগ্ন সকাল ৯টা ৯ মিনিট ২৩ সেকেন্ড থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা ৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত।
জামালপুর
জগতের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি ও পুণ্যলাভের আশায় জামালপুরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমী স্নান অনুষ্ঠিত হয়েছে। শেরপুর-জামালপুর সেতু এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ প্রান্তে হাজার হাজার হিন্দু পুণ্যার্থী অষ্টমী স্নানে অংশ নেন।
অষ্টমী স্নান উপলক্ষে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে শেরপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার হিন্দু পুণ্যার্থীদের মিলনমেলায় পরিণত হয় পুরাতন ব্রহ্মপুত্রপাড়। পুণ্যার্থীরা ফুল, বেলপাতা, ডাব, ধান, দূর্বা দিয়ে অর্চনা ও স্নান করেন।
স্নান শেষে পুণ্যার্থীরা স্থানীয় দয়াময়ী মন্দিরে পূজা ও অর্ঘ্য দেন। অষ্টমী স্নান উপলক্ষে প্রতিবারের মতো এবারও শহরের দয়াময়ী মন্দিরের আশপাশে তিন দিন ব্যাপী অষ্টমী মেলা বসেছে। অষ্টমী স্নানের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।
ময়মনসিংহ
হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব অষ্টমী স্নান উপলক্ষে ময়মনসিংহের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড়ে লাখো পুণ্যার্থীর ঢল নেমেছে। ভোর পাঁচটা থেকেই নগরীর থানা ঘাট, কাচারি ঘাট, গুদারাঘাটসহ নদের ওপারে শম্ভুগঞ্জ ঘাটে বিশাল এলাকাজুড়ে এই পুণ্যস্থান অনুষ্ঠিত হয়। এসময় ধর্মীয় মন্ত্র উচ্চারণে ফুল, ফল, হরতকিসহ পুণ্যর্থীরা ভক্তিমন্ত্রের স্নান উৎসবে মেতে ওঠেন।
পাপমোচনের বাসনায় প্রতিবছর অষ্টমী তিথিতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লাখো পুণ্যার্থীর ব্রহ্মপুত্রে স্নানোৎসবে ভিড় করেন। উৎসবকে ঘিরে নদ তীরবর্তী এলাকায় বসেছে অষ্টমী মেলা। এছাড়া জেলার বেগুনবাড়ি, বিদ্যাগঞ্জ, পিয়ারপুর, কালিরবাজার, ধলা, রৌহাসহ কয়েকটি স্থানের ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যার্থীরা অষ্টমীর স্নান ও পূজা সম্পন্ন করেন।
বরিশাল
প্রতিবছরের মতো এবারও অষ্টমী তিথিতে বরিশালের মাধবপাশায় দুর্গাসাগরে পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হয়েছে। গঙ্গাস্নানের মতো পুণ্য হয় বলে শনিবার সকাল থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পদচারণায় মুখরিত ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দীঘির প্রাঙ্গণ।
আর এই স্নানকে ঘিরে দুর্গাসাগরের পাড়ে নানা ধরণের পসরা নিয়ে মেলা বসেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এসেছেন পুণ্য তিথিতে স্নান করে পুণ্য লাভের জন্য।
কুড়িগ্রাম
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদে শুরু হয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুণ্যস্নান উৎসব। শনিবার ভোর থেকে এ স্নান উৎসব শুরু হয়। পিতা-মাতাসহ পূর্বপুরুষ ও নিজেদের পাপ মোচনের আশায় চিলমারীর থানাহাট ইউনিয়নের রমনা ঘাট থেকে রাজারভিটা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার ব্যাপী এলাকায় স্নানে অংশ নেয় লক্ষাধিক নারী ও পুরুষ। ছুটির দিন হওয়ায় এবারে পুণ্যস্নানে পুণ্যার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানান আয়োজকরা।
স্নান উৎসবে রংপুর বিভাগের সব জেলা ছাড়াও শেরপুর, জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলার সনাতন ধর্মের মানুষ এতে অংশ নেয়। স্নান উৎসব নির্বিঘ্ন করতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি পূণ্যার্থীদের পোশাক পরিবর্তনে বুথসহ অস্থায়ী ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চিলমারীতে আগত পুণ্যার্থীদের থাকার জন্য উপজেলার প্রায় ২২টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় খুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও পুণ্যার্থীদের স্নান পরবর্তী পোশাক পরিবর্তনের জন্য এবং রাত্রী যাপনের জন্য ৪৪টি অস্থায়ী বুথ করা হয়েছে। পুণ্যার্থীদের পূজাপর্বের জন্য প্রায় দুই শতাধিক ব্রাহ্মণ পূজারি দায়িত্ব পালন করেন।
শুক্ল তিথি অনুযায়ী শনিবার ভোর চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টা স্নানের উত্তম সময়। আর উত্তম লগ্ন সকাল ৯টা ৯ মিনিট ২৩ সেকেন্ড থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা ৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত। কিন্তু স্নানে অংশ নিতে শুক্রবার বিকেল থেকে সারা রাত বাস, মাইক্রোসহ বিভিন্ন যান-বাহনে এসে অবস্থান নেন পুণ্যার্থীরা।
মুন্সীগঞ্জ
পুণ্যস্নান রীতি মেনে মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরীতে পাপ মোচনের জন্য পুণ্যস্নান উৎসব করছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের হাজারো নারী পুরুষ ও শিশু- কিশোররা।
শনিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এ পুণ্যস্নান কার্যক্রম চলবে বলে জানান আয়োজক কমিটি। শহরের হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকা সংলগ্ন ধলেশ্বরী নদীতে বসেছে মহাতীর্থ এ অষ্টমী স্নান উৎসব। প্রায় পাঁচশ বছর ধরে চলা এ উৎসবকে ঘিরে ধলেশ্বরী তীরে বসেছে গ্রাম্য মেলা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এ আয়োজন ঘিরে পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে।
আয়োজকরা জানান, আদিকাল থেকে নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দের মতো মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরীর তীরেও এ রীতি চলে আসছে। যেখানে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের পুণ্যার্থীরা অংশ গ্রহণ করছেন।
কথিত আছে ব্রহ্মপুত্রের জল পাপমুক্ত করেছিলো পরশুরাম মুনিকে। আর এ বিশ্বাস নিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা লাঙ্গলবন্দসহ ধলেশ্বরী নদীতে স্নান করে পাপ মোচন প্রথা ধরে রেখেছে।
চাঁদপুর
চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পুর্ণের আশায় অন্য বছরের মতো এবারও চাঁদপুরের পুরান বাজারের হরিসভা এলাকায় নদীতে পুণ্যস্নান করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার পুণ্যস্নানে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। এই অষ্টমী স্নান উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানাতে সকালে স্নান এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক মহসীন উদ্দিন, পুলিশ সুপার আব্দুর রকিবসহ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ ও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দগণ। অষ্টমী স্নান নির্বিঘ্ন করতে পুলিশের বিভিন্ন সদস্য ছাড়াও দমকল বাহিনীসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা স্থানটিতে তৎপর রয়েছেন।