বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে পরিবহণ বন্ধ ও নেতাকর্মীদের বাধা দেওয়ায় রাজনৈতিকভাবে বিএনপিরই লাভ হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতাসীন দলের বাধার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে একধরনের জেদ তৈরি হয়েছে। বাধাকে অগ্রাহ্য করে সমাবেশ সফল করতে তারা আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ। তাদের মধ্যে সাংগঠনিকভাবে চাঙ্গাভাব তৈরি হয়েছে। বাধা দেওয়া না হলে অন্যান্য কর্মসূচির মতো এটাও গতানুগতিভাবেই পালিত হতো। কিন্তু এখন দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের নজর থাকছে সমাবেশ ঘিরে।
গণমাধ্যমগুলো সমাবেশের দু-একদিন আগে থেকেই তৎপর। এসব খবর বিএনপির প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ফলাও করে প্রচার করছে। পাশাপাশি মাঠের বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও অবহিত করা হচ্ছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে তারা নিজেরাও বিষয়গুলো দেখছে। এতে সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, বিএনপি প্রচারের সুযোগ পাচ্ছে সরকারবিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা দিচ্ছে। তাদের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকরা বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। এসব সমাবেশে বাধা দেওয়ায় দলটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কাড়তে সক্ষম হচ্ছে।
এসব প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বিএনপির সমাবেশ করার সম্পূর্ণ সাংবিধানিক অধিকার আছে। কিন্তু যেখানেই সমাবেশ ডাকা হয় সেখানেই যানবাহন ধর্মঘট হচ্ছে। সরকার বলছে এ ধর্মঘটে তাদের হাত নেই। কিন্তু দেশের মানুষ এতটা বোকা নয়। সমাবেশের নামে যদি জ্বালাও-পোড়ায় করে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার ফলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে সুবিধা পাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের ভাবমূর্তি বিপন্ন হচ্ছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, নেতাকর্মীদের ওপর হামলাসহ বেশ কিছু দাবিতে বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ করছে বিএনপি। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিভাগ দিয়ে এ কর্মসূচি শুরু হয়। ইতোমধ্যে চারটি বিভাগে গণসমাবেশ শেষ করেছে দলটি। চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের গণসমাবেশে ঘোষণা দিয়ে পরিবহণ বন্ধ করা হয়নি। তবে সমাবেশের আগের রাত থেকে অঘোষিতভাবে বন্ধ ছিল পরিবহণ। এ ছাড়া এসব কর্মসূচিতে বিচ্ছিন্নভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাধা দেওয়া হয়। কয়েক জায়গায় ঘটে হামলার ঘটনাও। ২২ অক্টোবর খুলনা বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করা হয় গণপরিবহণ। বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মীর ওপর হামলা চালায় ক্ষমতাসীনরা। সবশেষ রংপুরেও একই ঘটনা ঘটে। তবে ৫ নভেম্বর বরিশাল বিভাগের গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে শুধু বাস নয়, থ্রি-হুইলারও বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। বন্ধ রাখা হবে লঞ্চও। দুদলের নেতাকর্মীর মধ্যে চলছে পালটাপালটি শোডাউন। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা উত্তেজনা বিরাজ করছে বরিশাল ও আশপাশের জেলায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ। সরকারের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া না হলে এ নিয়ে ততটা আলোচনাই হতো না। স্বাভাবিক কর্মসূচির মতোই তা পালিত হতো। গণমাধ্যমে এ নিয়ে এতটা হইচই হতো না। কিন্তু পরিবহণ বন্ধ ও ক্ষমতাসীনদের বাধার কারণে রাজনীতিতে আলোচনার মূল কেন্দ্রে চলে আসে কর্মসূচিটি। গণমাধ্যমগুলোও তা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। প্রতিটি গণসমাবেশে ঢাকা থেকে পাঠানো হয় বিশেষ টিম। সমাবেশের দুদিন আগে থেকেই তা জাতীয়ভাবে ব্যাপক প্রচার ও প্রকাশ হতে থাকে। উত্তেজনার কারণে সবার নজরও থাকে ওই সমাবেশের দিকে। টিভি টকশোতে স্থান পায় বিএনপির গণসমাবেশ। এতে বলতে গেলে লাভই হচ্ছে বিএনপির। বিভাগীয় গণসমাবেশ ফলাও করে প্রচার ও প্রকাশের পর সারা দেশে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। সমাবেশে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি সবার মধ্যেই ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। সাংগঠনিকভাবে দলটি তাদের শক্তি জানান দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্ত এসব কর্মসূচিতে বাধা না দিলে গণমাধ্যমে তা এতোটা ফলাও করে প্রচার ও প্রকার হতো না। তাদের মতে, বাধা দেওয়ায় সমাবেশে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বাড়ানোর একটা প্রতিযোগিতা চলছে। এ কারণে তারা কোনো বাধাই আমলে নিচ্ছে না। যেকোনো মূল্যে সমাবেশে অংশ নিতে হবে এটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা দিয়ে সরকারের কোনো লাভ হচ্ছে না এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। গণসমাবেশে বাধার ফলে বিএনপির হয়তো কিছুটা লাভই হচ্ছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনগণ। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা গেছে, বিরোধীদের সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়ার চিত্র তথ্য-প্রমাণসহ কূটনীতিকদের অবহিত করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। বিভাগীয় গণসমাবেশ শেষ হওয়ার পর বাধা দেওয়ার নানা চিত্র তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। সেই প্রতিবেদন ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের দেওয়া হবে। তথ্য-প্রমাণসহ বাধার অভিযোগ পাওয়ার পর তারা সরকারকে এ ব্যাপারে চাপ দিতে পারবে। যাতে ক্ষমতাসীন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুটা হলেও চাপে থাকবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষও জেগে উঠেছে। বিএনপির গণসমাবেশে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিচ্ছে। সমাবেশে উপস্থিতি দেখে সরকারের মধ্যে একধরনের ভয় সৃষ্টি হয়েছে। সেই ভয় থেকেই তারা সমাবেশ পণ্ডে নানাভাবে বাধা দিচ্ছে। এতে সরকারের কোনো লাভ হচ্ছে না। বিএনপিকেই আরও এগিয়ে দিচ্ছে।