রাজনৈতিক দল হিসেবে স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এতে করে দলটির বর্ষীয়ান নেতাদের সঙ্গে হাইকমান্ডের সম্পর্কে অবনতি ঘটে।
দলের অন্দর মহলে ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে এ বিষয়টি দায়িত্বশীল নেতারা সংগঠনের শৃঙ্খলা বাস্তবায়নে সাংগঠনিক ব্যবস্থা বলে অভিহিত করছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিএনপিতে বিদ্রোহ আসন্ন।
সম্প্রতি বিএনপি থেকে বেশ কয়েকজন বর্ষীয়ান নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি অনেক নেতাকে দেওয়া হয়েছে কারণ দর্শানোর নোটিশ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটেছে।
সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের স্বাক্ষর করা এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলনকে একটি নোটিশ পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, আপনার (এহছানুল হক মিলন) অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আপনাকে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদ থেকে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে মনোনীত করা হয়েছে। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
এর আগে গত ২২ মার্চ আরেক নেতা বেলাল আহমেদকে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-দফতর সম্পাদক পদ থেকে সহ-গ্রাম সরকার বিষয়ক সম্পাদক পদে মনোনীত করা হয়।
বরিশাল বিএনপির দীর্ঘদিনের কাণ্ডারি ছিলেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট মো. মজিবর রহমান সরোয়ার। বরিশাল-৫ এর সাবেক এই সংসদ সদস্য বরিশালে একক আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি বরিশাল সিটির মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। গত বছরের নভেম্বরে স্থানীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে সেই মজিবর রহমানকে দলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়াও এ সময়ের মধ্যে খুলনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে। একই প্রক্রিয়ায় রাজশাহী মহানগর কমিটি থেকে বাদ পড়েন সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটিতে স্থান পাননি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সংসদ সদস্য হারুন অর রশিদের অনুসারীরা।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকেও দল থেকে সরিয়ে দেয় বিএনপি। আবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকেও দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ছয় বছর পর গত ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় সিলেট জেলা বিএনপির কাউন্সিল। সেখানে বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য আরিফুল হক চৌধুরীসহ ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মাধ্যমে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দলের সব পদবিসহ সাধারণ সদস্যপদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। একই বছর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত মাহবুবুর রহমান রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন।
এছাড়াও শমসের মবিন চৌধুরী ও এনাম আহমেদ চৌধুরীর মতো দুজন অভিজ্ঞ কূটনীতিকও হারিয়েছে বিএনপি। ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদকে কয়েক দফা কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে দলের হাইকমান্ড থেকে। একইভাবে বিব্রত করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকেও।
দলীয় সূত্রমতে, যে প্রক্রিয়ায় দলে পুনর্গঠন হচ্ছে এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীষণ রকমের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অবমূল্যায়নের শিকার অনেকেই ক্ষুব্ধ। এদের মধ্যে এর আগেও কেউ কেউ দল ছেড়ে চলে গেছে, কেউবা আবার দলীয় কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।
দলের ক্ষুব্ধ এসব নেতা বলছেন, কেউ কেউ দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ, কেউবা দুই যুগের বেশি সময় ধরে জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া তার আদর্শের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অনেকে তাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে পাঁচ, ছয় কিংবা সাতবারও জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সেই সঙ্গে একাধিকবার সিনিয়র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
অথচ দলে তুলনামূলক অনেক জুনিয়র নেতা বর্তমানে বারবার মূল্যায়িত, অতিমূল্যায়িত কিংবা সম্মানিত হচ্ছেন। ত্যাগী নেতারা দলীয় পদ-পদবিতে অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছেন। এতে নেতাকর্মীদের কাছেও এসব নেতা অসম্মানিত বোধ করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন সম্পাদক বলেন, দলে যেভাবে রদবদল শুরু হয়েছে তাতে যদি সম্মানজনকভাবে রাজনীতি করতে না পারি তাহলে অনেকের মুখোশ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে খুলে দেবো।
‘দেশের রাজনীতিতে বিএনপি একটা সম্ভাবনার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে যে রদবদলগুলো হচ্ছে তা দলের জন্য আত্মঘাতী। সারাদেশে নেতাদের অপমান করা হচ্ছে। যদি এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে তাহলে রাজনীতি ভিন্ন মাত্রায় চলে যাবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, দলে পরিবর্তন একটা চলমান প্রক্রিয়া। পরিবর্তন হবে, হওয়াটা স্বাভাবিক, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু যাদের পরিবর্তন করা দরকার তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে দেওয়া হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য যারা আছেন তাদের পরিবর্তন করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, বিএনপি ধ্বংসের শেষ ধাপ শুরু হয়েছে এই রদবদল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, যেখানে দক্ষ ও অভিজ্ঞ নেতাদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। বিএনপিতে এখন প্রেজেন্টেবল (নেতৃত্ব দেওয়ার মতো) নেতা নেই, যারা ছিলেন তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে আগামী নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনে প্রার্থী খুঁজে পাবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি তারেক রহমানের বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে দলের হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে এই বিক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা বিদ্রোহ তৈরি হতে পারে। অনেকেই হয়তো শেষ বয়সে এসে আরেকবার সংসদ সদস্য হওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন। পাশাপাশি যারা আগে এমপি-মন্ত্রী হয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন তারাও তাদের সম্পদ রক্ষার্থে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করতে পারেন।
মহিউদ্দিন খান বলেন, বিএনপির ধারণক্ষমতা বাড়ানো উচিত ছিল। অভিজ্ঞ নেতাদের সরিয়ে না দিয়ে আরও বেটার (দক্ষ) নেতাদের জায়গা দেওয়া উচিত ছিল। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এটা বুঝে করেছেন নাকি না বুঝে করেছেন সেটা আমার বোধগম্য নয়। কারণ একজন সচেতন মানুষ কখনো এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।
সূত্র বলেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন দলের ভেতরে থাকা কিছু নেতাকর্মী। এদের মধ্যে কয়েকজন চিহ্নিত। এছাড়া সন্দেহের তালিকায় থাকা অনেকেই নজরদারিতে আছেন এখন।
এর আগে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা জিয়াকে বাদ দেওয়ার দাবি উঠেছিল বিএনপির ভেতর থেকেই। আলাদা কমিটিও করেছিলেন সংস্কারবাদী নেতারা। তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছিলেন তারা। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা সফল হতে পারেননি।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দখলদার সরকার নিজেদের ঠেকিয়ে রাখতে এ সব খেলাধুলা করছে। কে গেলো, কে আসলো এতে বিএনপির কিছু আসে যায় না। বিএনপির শক্তি হলো জনগণের কাছে। অনেক বড় বড় নেতাও দল ত্যাগ করে সুবিধাভোগী হওয়ার জন্য এদিক সেদিক করেছে। কিন্তু বিএনপির কোনো সমস্যা হয়নি।
ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আজম খান বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তো থাকবেই। আমরা সচেতন আছি, দলের ভেতরে থাকা কোনো চক্রান্ত এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। কেউ অনিয়ম করে বা দলবিরোধী কার্যক্রম করে পার পাবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষ্য, দলে নেতৃত্বের কোনো সংকট নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমস্যা তো বিভিন্নভাবে দেখা দিয়েছে। এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতেই হয়, সে ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে।