আমরা পারস্পরিক আস্থাহীন, সম্পর্কহীন নির্মম এক বিভাজিত খুনে সমাজ নির্মাণ করে ফেলেছি। ক্ষোভ, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নাহিদের মতো অচেনা, অজানা মানুষজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। কারণ, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিভাজন দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এই সমাজে সবাই পরস্পরকে শত্রু জ্ঞান করে। আমার পক্ষে না এলেই অন্যকে শত্রু পক্ষে ঠেলে দিচ্ছি। এই ঠেলাঠেলির সমাজে আমরা অন্যায়–অনিয়মের বিরুদ্ধে যূথবদ্ধ হতে পারছি না। দুটো উদাহরণ দিলে আমাদের সমাজের ভাঙনকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। একটা হচ্ছে, সমাজে বিচার না চাওয়ার একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, আওয়ামী–সমর্থিত পরিবারের এক সন্তানের বিএনপি–সমর্থিত ছাত্রদলের রাজনীতি করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। এই দুটি উদাহরণ রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক এবং রাষ্ট্রের ভেতরে নাগরিকদের মধ্যকার আন্তসম্পর্ককে বুঝতে সাহায্য করবে।
বিচার না চাওয়ার প্রবণতা নিয়ে প্রথমে আলাপ করা যাক। প্রথমত, আমার খুবই অসহনশীল ও পারস্পরিক অবিশ্বাস নিয়ে নিষ্ঠুর এক সমাজে বসবাস করছি। এই সমাজে এখন দিনের আলোয় প্রকাশ্যে সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়। দিনেদুপুরে জনপ্রতিনিধিকে হত্যা করে উল্লাস করা হয়। হত্যাকারীদের পক্ষে শীর্ষ রাজনীতিবিদেরা সাফাই গান। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নাম বলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা আর ফিরে আসে না। এ নিয়ে আমরা খুব বেশি কথা বলি না।
ভেঙে পড়া এই সমাজে বসবাস করে জনসাধারণ সংগত কারণেই চরমভাবে হতাশ। তাই দেশের মানুষ এখন আর বিচার চায় না। বিচার ব্যবস্থার ওপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা একেবারেই উবে গেছে। থানা, পুলিশ, আদালত—সর্বোপরি সরকারকে কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
যেকোনো ঘটনার পরই আহত বা নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা প্রকাশ্যেই বলছেন, আমরা বিচার চাই না। কার কাছে বিচার চাইব। বিচার চেয়ে কী হবে। তাঁরা সবাই বিচারের ভার আল্লাহ হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। ঘুণে ধরা প্রহেলিকাময় শাসনব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। শাসককুলের প্রতি জনসাধারণ গণ–অনাস্থা জানিয়ে দিচ্ছে। এখন ভোটের মাধ্যমে অনাস্থা জানানোর সুযোগ নেই। তাই শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এই গণ–অনাস্থাই নিরীহ মানুষের গণপ্রতিবাদের অংশ।
জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা, বিচার না চাওয়ার সংস্কৃতি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি অকার্যকর হওয়ার কথাই বলে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আমাদের রাষ্ট্র যখন আরও শক্তিশালী হওয়ার কথা, তখন সমস্বরে সবাই বলছে, এই রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের কোনো ভরসা নেই। আমরা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কোনো আস্থা রাখতে পারছি না।
ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষে নাহিদ হাসান ছাড়াও মুরসালিন নামের আরও একজন নিহত হয়েছেন। নিহত দুজনের স্বজনেরা বলেছেন, তাঁরা বিচার চান না। তাঁরা মনে করেন, দেশে এখন বিচার বলতে কিছু নেই। এর আগে সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে কলেজছাত্রী সামিয়া আফরিন প্রীতি নিহত হন। প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিন বিচার চান না বলে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘বিচার চাইতে গেলে নানা ধরনের হয়রানি শিকার হতে হয়। বিপুল অর্থ খরচ করতে হয়। আমাদের সেই সামর্থ্য নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। আল্লাহর কাছে বিচার চাই।’
বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থার প্রকাশ কিন্তু এখানেই শুরু না। আরও আগে ২০১৫ সালে খুন হয়েছিলেন প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন। দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ছেলে–হত্যার বিচার চাননি। আরও অতীতে গেলে এ রকম আরও উদাহরণ পাওয়া যাবে। সমসাময়িক কালে নিজস্ব অভিজ্ঞতার কারণেই জনসাধারণ বিচার চাইছে না।
এই নাগরিকেরা দেখেছেন, সাংবাদিক সাগর–রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন ৮৫ বারের মতো পিছিয়েছে। নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যায় অভিযুক্তরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় শহরজুড়ে। তনু হত্যার কোনো সুরাহা হয়নি। লেখক, ব্লগাররা নির্বিচারে হত্যার শিকার হয়েছেন। সাধারণ মানুষ বেডরুম থেকে রাজপথ—কোথাও শঙ্কামুক্ত নয়। জন্মের আগে মায়ের গর্ভেই গুলিবিদ্ধ হচ্ছে শিশু। বাবার কোলোই সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা যাচ্ছে আরেক শিশু।
রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের ছিন্নতা সাধারণ নাগরিকের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে। যে কারণে কাজী রওনাকুল ইসলাম আওয়ামী–সমর্থিত পরিবার থেকে বিএনপির ছাত্রসংগঠনের সভাপতি হয়েছেন বলে তার পরিবার রীতিমতো সম্পর্কই ছিন্ন হওয়ার কথা জানিয়েছে। রওনকের বাবা সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেন, ১৩ বছর ধরে রওনক বাড়ি যান না। কী ভয়াবহ একটা অবস্থা! ছেলে সঙ্গে সম্পর্কহীনতার কথা বাবা অবলীলায় সবাইকে বলে যাচ্ছেন। মতভিন্নতা ও মতান্তর থাকতেই পারে, তাই বলে ভিন্ন রাজনীতি করার কারণে বাবা-ছেলের সম্পর্কই থাকবে না, এমনটা কী করে সম্ভব!
এই যে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকে অনাস্থা, বাবা-ছেলের সম্পর্কের ছিন্নতা, এসব খুব ভালো লক্ষণ না। এগুলো সমাজের ক্ষয়ে যাওয়ার সূচনাকে ইঙ্গিত করে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে, রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে, সমাজে ব্যক্তি ও সামষ্টিক জনসাধারণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে অনেকেই হয়তো রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নিচ্ছেন, কিন্তু দিন শেষে তা রাষ্ট্রের খুঁটিগুলোকে আলগা করে দেয়। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের জন্য নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক মিত্রতা, সহমর্মিতা, বোঝাপড়ার সম্পর্ক সৃষ্টি করা যেমন জরুরি, তেমনি নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি করাও আবশ্যক। এর কোনো বিকল্প নেই। যদি তা না হয়, তবে যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য সফলভাবে টিকে থাকা কষ্টকর।