যে সংস্থা ভিক্ষা করে চলে, সেই সংস্থার প্রধান নির্বাহীর বেতন কি সোয়া ছয় লাখ হওয়া উচিত? ভিক্ষা করে যদি সরকারি সংস্থা চলতে না পারে, তাহলে এত টাকা বেতন দিয়ে এমডি কেন রাখা হবে?
কথাগুলো এসেছে সরকারি সংস্থা ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ প্রসঙ্গে। সংস্থাটি আরেক দফা পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। কারণ, ওয়াসার পানির উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে অনেক ব্যবধান। বর্তমানে প্রতি ১ হাজার লিটার পানিতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১০ টাকা। সুতরাং দাম বাড়িয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে ওয়াসাকে। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান নিজেই বলছেন, ‘সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে কোনো সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না।’
ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি, ভিক্ষা করে চলতে হয়, সেই সংস্থার এমডির বেতন-ভাতা সর্বোচ্চ কত হবে? তাকসিম এ খান এখন বেতন-ভাতা পান মাসে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। দেশে সেবাদানকারী যত সরকারি সংস্থা আছে, সবচেয়ে বেশি বেতন-ভাতা পান ওয়াসার এমডি। এই এমডির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, তিনি পানির দাম ও নিজের বেতন পাল্লা দিয়ে বাড়াতে পারেন।
২০০৯ সালের অক্টোবরে তাকসিম এ খান ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরপর থেকে তিনি পানির দাম বাড়িয়েছেন ১৪ বার, আর নিজের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে নিয়েছেন ৪২১ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে কোন কোন বিষয় সমন্বয় করে এত বেতন বেড়েছে, সেটা অবশ্যই গবেষণার বিষয়। অথচ এই ১৩ বছরে একদিকে পানির দাম বাড়িয়ে তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়েছেন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষেরই করের টাকায় বেতন বাড়িয়েই চলেছেন। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে দায় নিতে হচ্ছে দুই দিক থেকেই।
ওয়াসা কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংককে চলতে হয় বাণিজ্যিকভাবে। এ জন্য সরকারি ব্যাংকের এমডিদের বেতন-ভাতা বেশি রাখা নিয়ে আলোচনা বহুদিনের। অথচ তাঁরাও বেতন-ভাতা ওয়াসার এমডির তুলনায় কম পান। ব্যাংক চলে সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থে। সেই অর্থ ফেরত দিতে হয়। আর ওয়াসা চলে সাধারণ মানুষের করের অর্থে, সেই পানিও আবার কিনে খেতে হয়। সঙ্গে পুষতে হয় প্রতিষ্ঠানের সবাইকে। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি গত ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক ও প্রেষণে নিয়োগ করা সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর চারটি মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বিশেষ পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। তখন কিন্তু সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নেওয়ার বিষয়টি আসেনি।
সবশেষ প্রশ্ন হচ্ছে, ওয়াসা কোন পানির দাম বাড়াতে চায়? যে পানি কমপক্ষে ফুটিয়ে পান করতে হয়? যে পানি খেতে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে ফিল্টার কিনে রাখতে হয়? যে পানি পাশে রেখে ১৫ টাকা দিয়ে এক গ্লাস পানির সমান বোতলজাত পানি কিনে খেতে হয়? ওয়াসার ব্যর্থতার জন্যই তো প্রতে৵ক মানুষকে পানির জন্য বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়। এ রকম একটি সংস্থার এমডির বেতন আসলেই কত হওয়া উচিত?
অবশ্য ওয়াসার এমডির বেতন এত বেশি হওয়ার একটিই কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। আর সেটি হলো, সম্ভবত এ কাজের জন্য তাঁর কোনো বিকল্প নেই। সেই ২০০৯ সাল থেকেই তিনি ওয়াসার চুক্তিভিত্তিক এমডি। সরকার যোগ্য আর কাউকে খুঁজে পায়নি বলেই তিনি ১৩ বছর ধরে এমডি। সুতরাং তাঁর বেতন তো বেশি হবেই।
তাহলে আসুন, আমরা আরেক দফা পানির মূল্য বৃদ্ধির অপেক্ষায় থাকি। আর বেতন-ভাতা বাড়ানো নিয়ে কথা কম বলি।