বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে করে রাজধানী দামেস্ক ছেড়ে পালিয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। সিরিয়ার বাশারবিরোধী রাজনৈতিক জোটের প্রধান হাদি আল-বাহরা রাজধানী দামেস্ককে ‘বাশার আল-আসাদমুক্ত’ ঘোষণা করেছেন।
পাশাপাশি সিরিয়ার জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি।
আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের শাসন-শোষণের ধারাবিরণীর শেষ কটা লাইন এভাবেই বিবৃত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
তবে গল্পের শুরুটা ১৯৭০ সালে এক সেনাঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। বাশার আল আসাদের বাবা বাথ পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হাফেজ আল-আসাদ সে বছর একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।
সামরিক বাহিনীতে নিজের শক্তিশালী অবস্থান কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। তার শাসন ছিল কেন্দ্রীভূত এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রতীক।
তার বিরুদ্ধে ১৯৮২ সালে হামা শহরে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিদ্রোহ দমনে গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। ওই ঘটনায় ১০ থেকে ২০ হাজার মানুষ নিহত হন। এই ঘটনা তার শাসনের এক কালো অধ্যায়।
২০০০ সালে হাফেজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর তার পুত্র বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় বসেন।
বাশার আল-আসাদ হলেন হাফেজ আল-আসাদের দ্বিতীয় সন্তান। দামেস্ক মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে তিনি লন্ডনে চক্ষু চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন এবং চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হন।
তার বড় ভাই বাসিল আল-আসাদ ছিলেন পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। তাই বাশার ছিলেন রাজনীতির বাইরে। তবে ১৯৯৪ সালে বড় ভাই বাসিল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে বাশার পরিবারের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন। বাবার নির্দেশে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং রাজনীতির প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন।
ক্ষমতা নেওয়ার আগে বাশার আল-আসাদকে একজন সংস্কারপন্থী হিসেবে দেখা হতো। তার ক্ষমতা নেওয়ার পর ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার ১০০ জন বুদ্ধিজীবী সামরিক আইন প্রত্যাহার, আরও বেশি স্বাধীনতা এবং বহুদলীয় রাজনৈতিক চর্চার জন্য তার কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এই আহ্বানের পর বাশার আল-আসাদ তার শাসনের শুরুর দিকে কিছু সীমিত সংস্কার চালু করেন, যার মধ্যে ছিল অর্থনীতিকে উদারীকরণ এবং কিছু রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা। এই সময়টি ‘দামেস্ক বসন্ত’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
তবে, এই সংস্কারগুলো বেশিদিন টেকেনি। শাসন আবারও কঠোর কর্তৃত্ববাদী রূপে ফিরে যায় এবং দমন-পীড়ন নতুন করে শুরু হয়। দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন অব্যাহত ছিল, যা জনমনে অসন্তোষের বীজ বপন করে। এই অসন্তোষের পরে আরও বড় সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়।
২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়ায় পৌঁছানোর পর বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং মুক্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে, যা বাশারের শাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।
জনগণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং দুর্নীতির অবসান দাবি করে। শাসকগোষ্ঠী এই বিক্ষোভের জবাবে সহিংস দমন-পীড়ন চালায়, যা দেশকে একটি গৃহযুদ্ধে ঠেলে দেয়।
সংঘাত ক্রমশ তীব্র হয় এবং জিহাদি গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন বিরোধী পক্ষ আবির্ভূত হয়। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কসহ বিদেশি শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ এই সংকটকে আরও জটিল করে তোলে।
২০১৩ সালের ২১ আগস্ট এই গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি নির্মমতার পরিচয় দেন বাশার। দক্ষিণ সিরিয়ার ঘৌটায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে বসেন তিনি। সহস্রাধিক লোক এই হামলায় মারা যায়।
পরে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার চাপের মুখে সিরিয়া তাদের রাসায়নিক অস্ত্র ভাণ্ডার ধ্বংস করতে সম্মত হয়। এই প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও রাসায়নিক হামলার রিপোর্ট মাঝেমধ্যে আসতে থাকে।
এই যুদ্ধে ৫ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ ঝরেছে। আর প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
২০২১ সালে বাশার আল-আসাদ অত্যন্ত এক বিতর্কিত নির্বাচনে ৯৫ শতাংশ ভোট নিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার পর ২০২২-২৩ সালের দিকে আরব রাষ্ট্রগুলো বাশারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন শুরু করে। ২০২৩ সালে সিরিয়া আরব লিগে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি একটি কূটনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তবে ইউক্রেন এবং ইসরায়েলের পরিস্থিতি বিদ্রোহীদের হাতে এক সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়।
গত মাস থেকে বাশার আল-আসাদবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো দ্রুত সাফল্য পেতে থাকে। বাশারের প্রধান দুই মিত্র ইউক্রেনে ব্যস্ত রাশিয়া এবং ইসরায়েলের সঙ্গে ছায়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ইরান এবার তাকে বাঁচাতে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ পাইনি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ উড়োজাহাজে করে রাজধানী দামেস্ক ছেড়েছেন। তবে তিনি কোথায় গেছেন, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তার গন্তব্য অজানা থাকলেও বাশারের শাসনের এখনেই শেষ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।