রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার খোলার প্রত্যয় নিয়ে চালু হচ্ছে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে সেতু ‘যমুনা রেল সেতু’। আজ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর উত্তাল যমুনার বুক দিয়ে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলবে ট্রেন। এতে মাত্র সাড়ে তিন মিনিটেই সেতু পার হবে রেল এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
সকাল ১০টায় যমুনা রেল সেতুর পূর্বপার ইব্রাহিমাবাদ রেলস্টেশনে আয়োজিত উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফাহিমুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনিচি ও জাইকার সাউথ এশিয়া ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেল ইতো তেরুয়ুকি। যমুনা রেল সেতুর পূর্ব ইব্রাহিমাবাদ স্টেশন থেকে বেলা ১১টা ২০ মিনিটের দিকে সিরাজগঞ্জ পশ্চিম প্রান্তে সয়দাবাদ রেলস্টেশন পর্যন্ত উদ্বোধনী ট্রেনে অতিথিও সংশ্লিষ্টরা সেতু পার হবেন। সেখানে ১১টা ৪০ মিনিটে সংবাদ সম্মেলন শেষে দুপুর ১২টার দিকে ইব্রাহিমাবাদ রেলস্টেশন পূর্ব প্রান্তে ফেরত আসবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, যমুনা রেল সেতু দিয়ে ট্রেন পারাপারে আগের তুলনায় কম সময় লাগবে। ডাবল লেনের সুবিধা পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ার তানভীরুল ইসলাম বলেন, রেল সেতুতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে সেতুতে পরবর্তী সময়ে রং করার প্রয়োজন হবে না।
যমুনা রেল সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মাসুদুর রহমান তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হবে স্বপ্নের এই রেল সেতুটি। এর পর থেকে আপ ও ডাউন সেতুর দুটি লেন দিয়ে ব্রডগেজ এবং মিটারগেজ ট্রেন চলাচল করবে। এতে যোগাযোগ, বাণিজ্য ও অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
একসময় প্রমত্তা যমুনা সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের শিল্পোসমৃদ্ধ জেলাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে উত্তরের জনপদগুলো ছিল অবহেলিত ও উন্নয়ন বঞ্চিত। যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ চালু হলে পরিবর্তন আসতে থাকে এসব জনপদের। উন্নয়নের ছোঁয়ায় পাল্টে যেতে থাকে উত্তরের জেলাগুলো। তবে ওই সেতুতে রেল যোগাযোগ চালু করা হলেও সেটা ছিল চরম বিড়ম্বনার। যাত্রীবাহী ট্রেন চললেও সেতু পার হতে তিন-চার গুণ বেশি সময় লাগত। ২০০৮ সালে মূল সেতুতে ফাটল দেখা দেওয়ায় ট্রেনের গতি আরও কমিয়ে ঘণ্টায় মাত্র ২০ কিলোমিটার করা হয়। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর সেতুটি নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ২০২১ সালের মার্চে যমুনা সেতুর ৩০০ মিটার উজানে পিলারের পাইলিংয়ের কাজের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয়। এরপর থেকেই উত্তরাঞ্চলবাসী স্বপ্নপূরণে শুরু হয় মহাকর্মযজ্ঞ। প্রকল্পের শুরুতে সেতুর নাম ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের ডিসেম্বরে সেতুর নাম পাল্টে যমুনা রেল সেতু রাখা হয়।
রেল সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। পরে তা ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থায়ন এসেছে দেশীয় উৎস থেকে এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকা।
জাপানের ৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। জাপান, ভিয়েতনাম, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের ৭ হাজারেরও বেশি কর্মীর টানা চার বছরের পরিশ্রমে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। সেতুটিতে ৫০টি পিলার, প্রতি দুই পিলারের মাঝে একটি করে মোট ৪৯টি স্প্যান রয়েছে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার হলেও দুদিকে ৭ দশমিক ৬৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেন্ট এবং লুপ, সাইডিংসহ মোট ৩০ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে।