লবিং বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আলোচিত বিষয়। এর কোনো নিখুঁত বাংলা নেই। তবে লবিংয়ের কাছাকাছি মানে হতে পারে তদবির। বাংলাদেশে তদবিরকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। তদবির করা হয় অপ্রকাশ্যে, এর উদ্দেশ্য থাকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ। এ দেশে তদবির করতে পারেন প্রধানত সরকারি দলের সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান বা দলের অনুগতরা।
পাশ্চাত্যের লবিংয়ের ধারণাটি কিছুটা ভিন্ন। সেখানে লবিংয়ের সরল মানে হচ্ছে সরকারি নীতি বা সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো নাগরিক গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টা। ইংল্যান্ডে শতাধিক বছরের আগের ঐতিহ্য এটি। পার্লামেন্টের লবিতে এমপিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ ধরনের প্রবণতার শুরু, লবিং নামটি এসেছে সেখান থেকে।
ইউরোপের বহু দেশে লবিং প্রচলিত হলেও এর সবচেয়ে প্রসার দেখা যায় আমেরিকায়। ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, শ্রমিক ইউনিয়ন, কৃষক, পরিবেশবাদী, মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপের লবিস্ট রয়েছে সেখানে, রয়েছে রাজনৈতিক গোষ্ঠীর লবিস্ট। পেশাদারভাবে লবিং করার জন্য আছে হাজার হাজার নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। আইন বা নীতির খসড়া ও এসবের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে গবেষণা এবং তা মন্ত্রী বা আইনপ্রণেতাদের জানিয়ে তাঁদের প্রভাবিত করার চেষ্টাও থাকে লবিস্টদের।
পাশ্চাত্যে, বিশেষ করে আমেরিকার মতো ক্ষমতাধর দেশে অন্য রাষ্ট্রও লবিস্ট নিয়োগ করে থাকে। বিনিয়োগ ও ব্যবসাসুবিধা পেতে লবিং করে থাকে অন্য রাষ্ট্রের বেসরকারি খাতও। লবিং আইনগতভাবে কতটা নিয়ন্ত্রিত থাকা উচিত, এ নিয়ে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও লবিংকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয় না সেখানে।
আমেরিকায় লবিং করা নিয়ে সরকার এখন অভিযুক্ত করছে বিএনপিকে। এই অভিযোগ আসছে গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশ ডাক না পাওয়া ও র্যাব-পুলিশের কিছু কর্মকর্তার ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার পর। বিএনপির লবিংয়ের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সরকারের মন্ত্রীরা। কিন্তু বিএনপি ঠিক কী বিষয়ে লবিং করছে বা এর সঙ্গে উপরিউক্ত পদক্ষেপগুলোর কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা পরিষ্কার করে বলছেন না।
প্রশ্ন উঠছে সরকারের লবিং নিয়েও। দুদিন আগে সাংবাদিক কামাল আহমেদের প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়, সরকারের কারও কারও পক্ষ থেকে প্রথমে এটি আড়াল করার চেষ্টা ছিল। কিন্তু এখন জানা গেছে আমেরিকার সরকার, আইনপ্রণেতা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই লবিং চলছে অন্তত ২০১৪ সাল থেকে।
লবিং কে করছে, এর ব্যয়ের উৎস কী, তা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এর উদ্দেশ্য এবং এটি দেশের স্বার্থানুগ কি না, তা জানা। লবিং নিয়ে স্বচ্ছতা জনস্বার্থে প্রয়োজন তাই।
আইন মেনে লবিং করা হলে তা কোনো অপরাধ নয় আমেরিকায়। বরং অনেক আইনবেত্তা ও অঙ্গরাজ্যের আদালতের মতামত হচ্ছে লবিং আমেরিকার সংবিধানের প্রথম সংশোধনী দ্বারা অনুমোদিত। লবিংয়ের পক্ষে আরও যুক্তি দেওয়া হয় সেখানে। একে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব হিসেবে পার্টিসিপেটরি ডেমোক্রেসির প্রকাশ হিসেবে দাবি করা হয়। লবিংয়ের কারণে বহু পরস্পরবিরোধী স্বার্থ সরকার বুঝতে সক্ষম হয় বলা হয়।
লবিং তাই বলে অনিয়ন্ত্রিত নয় সেখানে। যেমন ১৯৯৫ সালের লবিয়িং ডিসক্লোজার আইনে লবিং প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন ও বিভিন্ন তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়, লবিংয়ের নামে কোন ধরনের কাজ অবৈধ এবং এর শাস্তি কী, তার বিবরণ দেওয়া হয়। তবে ১৯৯৫ সালের আইনটি আরও শক্ত করার পক্ষে মত রয়েছে। যেমন এই আইনে কোনো উপহার বা বিনোদন খরচ বহন নিষিদ্ধ করা হলেও এতে পার্লামেন্ট সদস্যদের ক্যাম্পেইন কমিটিগুলোকে পাঁচ লাখ ডলার পর্যন্ত ডোনেশন দেওয়ার সুযোগ আছে। এটি বন্ধ করতে কংগ্রেশনাল ক্যাম্পেইন পরিচালনার জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করা হচ্ছে কিছু মহল থেকে।
তবে এসব বিতর্ক আমেরিকায় লবিংয়ের প্রসারকে থামাতে পারেনি। সেখানে পেশাদার লবিং প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে অব্যাহতভাবে। ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর তিন বিলিয়নের বেশি অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে লবিংয়ে।
আমেরিকায় লবিং করে থাকে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোও। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইসরায়েল, চীন, ভারত, সৌদি আরব ও তুরস্ক। বিদেশি রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের জন্য লবিং বৈধ সেখানে। তবে আমেরিকার ১৯৩৮ সালের ফরেন এজেন্ট রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট অনুসারে, লবিস্ট কোন বিদেশি শক্তির পক্ষে, কত টাকার বিনিময়ে লবিং করছে, লবিংয়ের জন্য কী ‘ইনফরমেশন ম্যাটেরিয়ালস’ পাঠাচ্ছে, তা জানাতে হয় ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসকে। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষেও তা জানার সুযোগ থাকে অনেক ক্ষেত্রে।
সম্প্রতি ওপেন সিক্রেট নামের একটি ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের লবিংয়ের তথ্য বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। লবিংয়ের জন্য বাংলাদেশ সরকার শুধু বিজিআর নামক প্রতিষ্ঠানকে দুই কোটি টাকার মতো প্রদান করেছে। লবিংয়ের অর্থ ব্যয় হয়েছে মার্কিন আইনপ্রণেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করার জন্য এবং দেশের অর্থনীতির উজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরার জন্য।
লবিংয়ের অর্থ ব্যয় হয়েছে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনসংক্রান্ত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো অস্বীকার করার জন্যও। যেমন সরকারের পক্ষে লবিংয়ে বলা হয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গুমের যেসব অভিযোগ তুলছে তা ‘অপ্রমাণিত’, নির্যাতন বিষয়ে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ রয়েছে, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের বিষয়ে বলা হয় যে তিনি সাংবাদিক হিসেবে তখন কাজ করছিলেন না, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে আটকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করা মুশতাকের বিষয়ে বলা হয় তিনি কোনো রকম নির্যাতনের শিকার হননি, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কোনো অপপ্রয়োগ হচ্ছে না ইত্যাদি।
সংবাদমাধ্যমের এখন পর্যন্ত বিএনপির লবিং ঠিক কী বিষয়ে, তা নিয়ে তথ্য চোখে পড়েনি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, লবিংয়ের মাধ্যমে বিএনপি ও জামায়াত দেশবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব বাংলাদেশে উন্নয়ন সহায়তা বন্ধ করতে চিঠি দিয়েছেন, এটিও বলেছেন তিনি। যদিও গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর করা অভিযোগ নাকচ করেছে। আমরা আশা করব, লবিংয়ে বিএনপির অর্থের উৎসের বিষয়ে তদন্তের পাশাপাশি এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য প্রকাশ করা হবে। ২০০৪–২০০৫ সালে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ আমেরিকায় যে লবিং করেছিল, সে বিষয়েও তদন্ত করে জনগণকে জানানো হবে। জনগণের অর্থ সরকার কী প্রক্রিয়ায় বা কেন লবিংয়ের জন্য ব্যয় করছে, তারও ব্যাখ্যা দেওয়া হবে।