ষাটোর্ধ্ব মমতাজ বেগম ঢাকায় এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। চিকিৎসা শেষে বরগুনার বামনায় নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন স্বামী গোলাম রহমানের সঙ্গে। উঠেছিলেন ‘অভিযান-১০’ লঞ্চের ৩১২ নম্বর কেবিনে। রাত ৩টার দিকে লঞ্চটি বিষখালীর মোহনায় পৌঁছার পর আগুনের বিষয়টি টের পান তারা। ততক্ষণে আগুন লঞ্চটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ স্থানে পৌঁছে গেছে। এমন সময় তারা দুজনে দৌড়ে কেবিন থেকে বেড় হয়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখেন গেট বন্ধ।
অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও তারা গেট খুলতে না পেরে তৃতীয় তলার রেলিংয়ে মমতাজের শাড়ি বেঁধে স্বামী গোলাম রহমান তাকে কোনোমতে দ্বিতীয় তলায় নামান। পরে তিনি নিজেও ওই শাড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় নামেন। এরপর নিচে নামার আর কোনো উপায় খুঁজে পাননি এই দম্পতি। উপায়ান্তর না পেয়ে বৃদ্ধ ও অসুস্থ স্ত্রীকে দ্বিতীয় তলা থেকে নিচে পানিতে ফেলে দেন স্বামী গোলাম রহমান। এরপর নিজেও লাফ দিয়ে স্ত্রীকে ধরে কোনো মতে তীরে ওঠেন।
এতে স্ত্রী মমতাজ বেগমের কোমরে প্রচণ্ড আঘাত পান। স্থানীয়রা তাকে গরম কাপড় দিলে তারা দুজনেই গ্রামের বাড়ি বামনায় ফিরে আসেন। তারা বর্তমানে বামনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রয়েছেন।
শুধু মমতাজ বেগমই নন, অভিযান-১০ লঞ্চের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন বামনা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী নাজমুল হুদার মা নাসরিন বেগমও (৬৫)। তিনি কুমিল্লায় মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিলেন। চাঁদপুর থেকে তিনি লঞ্চে ওঠেন। আগে থেকেই ছেলে তার জন্য ৩১৭ নম্বর কেবিনটি বুকিং করেছিলেন। তাকে লঞ্চে কেবিনে পৌঁছে দিতে আসেন নাতি মেহেদী হাসান। লঞ্চ দ্রুত চাদঁপুর ঘাট ছেড়ে দেওয়ায় মেহেদীও রয়ে যান লঞ্চে। রাত ৩টার দিকে নাসরিন বেগম লঞ্চে পোড়া গন্ধ টের পান।
এরপর নাতিকে নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে দেখেন আগুনের লেলিহান শিখা। বৃদ্ধ নারী নাতিকে নিয়ে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। ইতিমধ্যে লঞ্চের সব লাইট বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে লঞ্চটির পুরো বডি গরম হয়ে যায়। নাতি মেহেদী লঞ্চের পাশে গেলে একজন তার গায়ের ওপর পড়ে। তার সঙ্গে তিনিও তিন তলা থেকে ছিটকে নিচে পানিতে পড়ে যান।
নাতিকে হারিয়ে বৃদ্ধ নাসরিন আক্তার কী করবেন ভেবে পান না। এদিকে প্রচণ্ড তাপে পায়ের তলা পুড়ে যাচ্ছিল তার। তিনি উপায় না পেয়ে তিন তলা থেকে জীবনের মায়া ত্যাগ করে নিচে ঝাঁপ দেন। এর পর কিভাবে তীরে উঠেছেন সে ঘটনা তিনি মনে করতে পারছেন না। তিনিও বর্তমানে বামনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
আগুনের উৎপত্তিস্থল স্পষ্ট দেখেছেন বামনা উপজেলার ব্যবসায়ী গোবিন্দ সাহা। তিনি তখন লঞ্চটির নিচতলায় সামনের দিকে শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি ইঞ্জিনরুমে আগুন দেখতে পান। তিনি তাৎক্ষণিক দৌড়ে তিন তলায় সুকানির কাছে গিয়ে লঞ্চের আগুনের বিষয়টি বলেন। তিনি তাকে লঞ্চটি তীরে নিতে অনুরোধ করেন। পরে তিনি আবার নিচে চলে আসেন। এমন সময় লঞ্চটির প্রায় অর্ধেক অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। লঞ্চটির ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ায় তীরে নেওয়ার চেষ্টা করলেও ভাটায় লঞ্চটিকে মাঝনদীর দিকে নিয়ে যাচ্ছিল বলে দাবি তার। তিনি তখন কোনোমতে ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়েন। পরে দেখতে পান লঞ্চের শেষকৃত্য।
সুগন্ধা নদীতে ‘অভিযান-১০’ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত বামনা উপজেলার অন্তত ২৫ জন যাত্রী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তারা বামনা উপজেলাসহ ঝালকাঠি ও বরিশালের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে এ উপজেলার কোনো যাত্রীর মৃত্যুর সংবাদ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ নামের চলন্ত লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে শিশুসহ এখন পর্যন্ত ৪০ জন মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দগ্ধ হয়েছে কমপক্ষে শতাধিক মানুষ। শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) ভোররাত ৩টার দিকে লঞ্চটিতে আগুন লাগে বলে জানা যায়।