নতুন প্রতারণায় বেশ কয়েকটি ট্রাভেলস এজেন্সি বিদেশগামী যাত্রীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। অগ্রিম টিকিট কেটে দেওয়া সংশ্লিষ্ট যাত্রীর টিকিটের অনুকূলে থাকা পুরো টাকা রিফান্ড করে নিচ্ছে অসাধু ট্রাভেলস এজেন্সি বা এজেন্সির সাব-এজেন্টরা। বিষয়টি আগে থেকে জানার সুযোগ থাকছে না যাত্রীদের। আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অনেক আশা করে বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে যাওয়ার পর ভুক্তভোগীরা অবগত হচ্ছেন প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি। তাও প্রথম দফায় নয়, দ্বিতীয় দফায় প্রতারিত হওয়ার পর তারা জানতে পারছেন আসল কাহিনি। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, আসন্ন হজকে ঘিরে প্রতারকচক্রের সদস্যরা ই-টিকিটিংয়ের ক্ষেত্রে বিছিয়েছে প্রতারণার জাল। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন ঢাকা মাহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ নিয়ে মঙ্গলবার রাজধানীর ভাটারা থানায় একটি মামলাও হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে এসব তথ্য।
একটি এজেন্সির প্রতারণার শিকার হয়ে ভাটারা থানায় মামলা করেছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড সার্ভিস সুপারভাইজার মো. সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, এম আদ্যাক্ষরের একটি প্রতিষ্ঠানের সিইও পরিচয়দানকারী কর্মকর্তার সঙ্গে তার কয়েক মাস আগে পরিচয় হয়। ওই ব্যক্তি দাবি করেন তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিকিট কিনে যাত্রী পাঠান। ২৬ মার্চ সাইদুর রহমান ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, পাঁচজন যাত্রীর জন্য মাস্কট, রিয়াদ, টরেন্টোর টিকিট কেটে দিতে হবে। আশ্বাস পেয়ে তিনি ওইদিনই সাইদুরের ভাটারা অফিসে গিয়ে মাস্কটের যাত্রী মুসাহিদের টিকিটের বাবদ তার কাছে ৭৬ হাজার টাকা দেন। পরে ওই ব্যক্তি মুসাহিদের নামে বুকিং করা একটি টিকিটের কপি পাঠান।
পরদিন ২৭ মার্চ বিকালে রিয়াদগামী যাত্রী মো. মহসিনের টিকিটের জন্য ৬৭ হাজার এবং টরেন্টোর জন্য মো. যুবায়ের হোসেন ও তার পরিবারের দুই সদস্যের জন্য ৩ লাখ ৭০ হাজারসহ মোট ৫ লাখ ১০ টাকা দেন সাইদুর। এর বিপরীতে ওই ব্যক্তি মাস্কট ও রিয়াদের যাত্রীদের দুটি টিকিট সরবরাহ করেন। কিন্তু ২৮ মার্চ রিয়াদের যাত্রী মহসিন বিমানবন্দরে এসে জানতে পারেন তার টিকিটটি ভুয়া। টিকিটের টাকা রিফান্ড করে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি মহসিন সাইদুরকে জানালে তিনি ওই ব্যক্তির (এম আদ্যাক্ষরের) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে তিনি আরেকটি টিকিট ইস্যু করে দিলেও সেই টিকিট দিয়ে মহসিন রিয়াদ যেতে পারেননি। তখন সাইদুর এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ টিকিট যাচাই করে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন।
পরে জানতে পারে টরেন্টোর তিনটি টিকিটের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রতারণা করা হয়েছে। এরপর অফিসে গিয়ে দেখা যায় তালা ঝুলছে। অফিসের সবার মোবাইল ফোন বন্ধ। এভাবে অনেক মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন এম আদ্যাক্ষরের মালিকানাধীন ট্রাভেলস এজেন্সি।
ডিবির উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, আমরা বেশকিছু ট্রাভল অ্যান্ড ট্যুর এজেন্সির খবর পাচ্ছি। যারা ব্যক্তি পর্যায়ে বা সাব-এজেন্টের কাছে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অগ্রিম টিকিট বিক্রি করেন। নির্দিষ্ট টাকা দেওয়ার পর তারা যাত্রীদের কাছে ই-টিকিট সরবরাহ করেন।
টিকিটে নাম-ঠিকানা সবই সঠিক থাকে। ওই টিকিট পাওয়ার পর যাত্রী নিশ্চিত হয়ে টিকিটটি পাসপোর্টের সঙ্গে রেখে দেয়। নির্দিষ্ট দিনে লাগেজ নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়। বিমানবন্দরে গিয়ে বোর্ডিং পাশ নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, আপনার বুকিং সঠিক ছিল। কিন্তু বুকিং দেওয়ার এক বা দুদিন পর সমুদয় টাকা রিফান্ড করা হয়েছে। তাই এ টিকিট দিয়ে আর ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। এ ধরনের অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। সবগুলো ঘটনাতেই যেন যাত্রীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তাদের কানেক্টিং ফ্লাইটগুলো মিস হয়। ডিসি মশিউর রহমান বলেন, যারা প্রতারিত হয়েছেন তাদের কেউ কাজের উদ্দেশ্য, কেউ চিকিৎসার জন্য এবং কেউ জরুরি মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়তে চেয়েছিলেন। কেউ পড়াশোনার জন্য বা নিয়মিত চাকরিতে যোগদানের জন্য এয়ার টিকিট কিনেছিলেন।
বিমানবন্দরে বাধার সম্মুখীন হওয়ার পর যাত্রীরা সংশ্লিষ্ট এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে নানা অজুহাত দেখিয়ে জরিমানা নেওয়ার পর আবার টিকিট ইস্যু করে। নির্ধারিত দিনে ফের বিমানবন্দরে গেলে সেই টিকিটটি ভুয়া হিসাবে প্রমাণিত হয়। পরে আর ওই টিকিট এজেন্সির লোকজনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখেন। এমনকি অফিসে গিয়ে দেখা যায়, অফিস বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে গেছেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, এটা একটি অভিনব প্রতারণা। আমরা আশঙ্কা করছি, আসন্ন হজ মৌসুমে এসব প্রতারকরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। তখন একটি বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এ বিষয়টি সামনে রেখে আমরা কাজ করছি। প্রতারণার সঙ্গে জড়িত এজেন্সিগুলোকে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, এই এজেন্সিগুলোর সঙ্গে যেসব কর্তৃপক্ষ কাজ করবে তাদের সচেতন হওয়া উচিত। যথাযথ কর্তৃপক্ষ সচেতন হলে সাধারণ মানুষ প্রতারণা থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবে। কর্তৃপক্ষ প্রো-অ্যাকটিভ কাজ করলে প্রতারকদের সমূলে উৎপাটন করা না গেলেও প্রতারকদের লোভ কিছুটা সংবরণ করানো যাবে। তিনি আরও বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। দেখি বিদেশগামী যাত্রীদের আমরা কতটুকু স্বস্তি দিতে পারি।