নবী হোসেনকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা
* সহস্রাধিক সদস্যের সশস্ত্র বেতনভুক্ত বাহিনী রয়েছে নবীর
* প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী
বাংলাদেশের ভেতর রোহিঙ্গাদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের আকাশ-কুসুম পরিকল্পনা করছে ভয়ংকর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে প্রথমে সে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দাবি করে আন্দোলন শুরু করবে। পরে সেই আন্দোলন থেকে ‘স্বাধীন রোহিঙ্গা রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার ডাক দেওয়া হবে।
তাকে এ কাজে সহযোগিতা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এমনি ভয়ংকর তথ্য এসেছে রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকেই। যাচাইয়ে নেমে এর সত্যতাও পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সূত্র বলছে, স্বপ্ন পূরণে নবী হোসেন এখানে অস্ত্রধারী শক্তিশালী বাহিনী তৈরি করছে। মজুত করছে বিপুল অস্ত্র। মজুত বাড়াতে সম্প্রতি হাজার কোটি টাকা মূল্যের বিশাল অস্ত্রের চালান আনার প্রক্রিয়া শেষ করেছে সে। তবে অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীই নবী হোসেনের হাতে অস্ত্রের ওই চালান তুলে দিতে চায়। তার মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
আর এ কারণে নবীকে হন্যে হয়ে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দারা। তাকে ধরিয়ে দিতে সম্প্রতি পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মালিক এই নবী হোসেন। মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কাজের মাধ্যমে এত অর্থের মালিক বনেছে সে। তার রয়েছে বেতনভুক্ত সশস্ত্র বাহিনী। রয়েছে রোহিঙ্গা ভাষায় বেশ কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী হোসাইন কবির বলেন, নবী হোসেন দেশের জন্য হুমকি। তাকে ধরতে ৩৪ বিজিবির পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আরেক ত্রাস মাস্টার মুন্না। সে নবী হোসেন বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড। দেশে ৫০ ভাগের বেশি মাদক তাদের হাত ধরে ঢুকছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গেও নবী হোসেনদের সুসম্পর্ক রয়েছে।
তদন্তে নেমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, পার্শ্ববর্তী একটি দেশের অস্ত্রের কালোবাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার অত্যাধুনিক ও ভারী অস্ত্র কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ত্রাস নবী হোসেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় থাইল্যান্ড থেকে মিয়ানমার হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ অস্ত্রের চালান আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টি জানতে পেরে অস্ত্র চালানের প্রবেশ ঠেকাতে সংস্থাটি তৎপরতা বাড়িয়েছে।
ওই গোয়েন্দা সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, নবী হোসেন অস্ত্রের চালান বাবদ ইতোমধ্যে এক হাজার কোটি টাকা কালোবাজারি অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছে দিয়েছে। তবে এখনো অস্ত্র আনতে পারেনি। মানব পাচার ও মাদকের জন্য পরিচিত মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মোই নদী-মায়ে সোট এবং বার্মিজ শহর মায়াওয়াদ্দি হয়ে এ চালানটি আনার চেষ্টা করছে তারা। মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা সরকার জড়িত না থাকলে এটি কখনো সম্ভব নয়।
নবী হোসেন অস্ত্র কেনার জন্য এত বিপুল অঙ্কের টাকা কোথায় পেল জানতে চাইলে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দেশে বেশিরভাগ মাদকের চালান ঢুকছে নবী হোসেনের হাত ধরে। ইয়াবার পাশাপাশি ভয়ংকর মাদক আইসের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। এ ছাড়া আরও নানা অপরাধমূলক কাজের মাধ্যমে সে ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দিনদুপুরে ডাকাতি, অপহরণ ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়ে ২০১৮ সালে প্রথম আলোচনায় আসে নবী হোসেন। সে রোহিঙ্গাদের কাছে ‘মাস্টার নবী হোসেন’ বলেও পরিচিত। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে নবী হোসেন বাহিনীর হাতে ৫ শতাধিক অস্ত্র ছিল। এখন তা বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে। দেশীয় অস্ত্রগুলো পাহাড়ি এলাকায় নিজস্ব কারখানায় বানানো হয়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমার থেকেও অস্ত্র এসেছে।
রোহিঙ্গাদের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে নবী হোসেনের অধীনে সহস্রাধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য রয়েছে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ করে পর্যায়ক্রমে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এসব সদস্যদের প্রত্যেককে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন দেয় নবী হোসেন। এ ছাড়া নিয়মিত মাদক চালানের কমিশনও পায় বাহিনীর সদস্যরা।
জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর আরাকানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরসার বিরুদ্ধে ক্যাম্পে জনমত গড়ে উঠেছে। প্রশাসনের পাশাপাশি তাদের প্রতিরোধ করছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। এতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার চেইন অফ কমান্ড ভেঙে পড়ে। এই সুযোগে ক্যাম্পে শক্তি বৃদ্ধি করে নবী হোসেন বাহিনী। রোহিঙ্গা ভাষায় বেশ কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেল চালু করে নানা কার্যক্রম প্রচার করে।
এরমধ্যে রয়েছে RRV News, RVR News, RRt News, Mayyu tv। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ও মিয়ানমার থেকেও এসব চ্যানেল পরিচালনা করা হয়। মিডিয়া টিমের দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে মাস্টার মুন্নার দুই ভাই ইদ্রিস ওরফে জুবাইয়ের ও ওমর ফারুক।
নবী হোসেন বা মাস্টার মুন্নার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে এসব চ্যানেলে আরসার তকমা লাগিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, আরসা যেমন রোহিঙ্গাদের জন্য হুমকি তেমনি নবী হোসেন ও মাস্টার মুন্না গ্রুপও রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি পুরো অঞ্চলের জন্য হুমকি।
সূত্রমতে, নবী হোসেন কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী তোতার দ্বীপে অবস্থান করছে। সেখান থেকে যখন-তখন মিয়ানমারে যাওয়া-আসা করতে পারে সে। নাফ নদীর ওই দ্বীপে দেশের কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো পৌঁছাতে পারেনি। অন্যদিকে মাস্টার মুন্না দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই রয়েছে বলে শোনা যায়। এরপরও সে ও তার সহযোগীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের হাতে ৩০ হাজারের বেশি অস্ত্র রয়েছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময়ে আমাকে ও ইউনিয়নের বিভিন্ন জনকে হুমকি দিয়েছে। আমি মনে করি রোহিঙ্গাদের দেখভালে গঠিত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলা ও যথাযথ তৎপরতা না থাকার কারণেই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ঢিলেমি বন্ধ করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪-এপিবিএনের অধিনায়ক পুলিশ সুপার নাঈমুল হক বলেন, মাস্টার মুন্না ক্যাম্পে আছে কিনা তার সঠিক তথ্য নেই। তবে নবী হোসেন ও মাস্টার মুন্না এবং তাদের সহযোগীদের ধরতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যে কোনো সময় হয়তো সফলতা আসবে।
র্যাব-১৫ কক্সবাজারের অধিনায়ক লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম সরকার বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা দেখভাল করার জন্য সেখানে একটা আলাদা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। তাই শতভাগ নিশ্চিত হয়ে আমরা শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বড় অভিযানগুলো পরিচালনা করে থাকি।
তিনি বলেন, নবী হোসেন ও মাস্টার মুন্না যেহেতু বড় মাপের সন্ত্রাসী তাই তাদের ধরার জন্য আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
নবী হোসেনের সহযোগী কারা : অনুসন্ধানে জানা গেছে, অংজউয়িং নামে মিয়ানমারে একজন পার্লামেন্ট মেম্বার রয়েছেন। তার আসল নাম জকির আহমেদ। তিনি আরাকান রাজ্যের নাকপ্পুরার মৃত নুরুল আলমের ছেলে। বর্তমানে থাকেন ইয়াঙ্গুনে। এমপি অংজউয়িং নবী হোসেনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং সন্ত্রাসী মাস্টার মুন্নার আপন চাচা।
অংজউয়িংয়ের পরামর্শে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী নবী হোসেনদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে থাকে। এরই অংশ হিসাবে মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে গড়ে ওঠা অর্ধশতাধিক ইয়াবা ও আইসের কারখানার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নবী হোসেন ও মাস্টার মুন্নার হাতে। বিনিময়ে বাংলাদেশে মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে তারা।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এখন নবী হোসেনের হাতে হাজার কোটি টাকা মূল্যের বিশাল অস্ত্রের চালান তুলে দিতে চায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এ ছাড়াও আমেরিকা প্রবাসী রোহিঙ্গা নেতা হাবিব উল্লাহ ও সৌদি প্রবাসী রোহিঙ্গা নেতা হাফেজ কবিরও নবী হোসেনদের পরিকল্পনায় জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমি প্রথম থেকে বলে এসেছি, পররাষ্ট্র নীতি ও কূটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গা সংকট কখনো সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই যদি হতো ১৯৭১ সালে যুদ্ধ না করে এ বাংলাদেশ স্বাধীন হতো। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আমরা নাফ নদীতে যুদ্ধ করেছি, তাদের আমি ভালোভাবে চিনি।
তিনি বলেন, নবী হোসেন হয়তো রোহিঙ্গা বেশে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সে মিয়ানমার সরকার ও দেশটির সেনাবাহিনীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আজকে হাজার কোটি টাকার অস্ত্র আনার চেষ্টাও মিয়ানমারের ষড়যন্ত্রের অংশ। যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। না হয় রোহিঙ্গা সংকট আরও ভয়াবহ হবে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, হাজার কোটি টাকার অস্ত্রের চালান আনার চেষ্টার বিষয়টা এখনো আমি জানি না। বিস্তারিত জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশবিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত বেশ কয়েকটি এনজিওর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।