শনিবার , ১৩ আগস্ট ২০২২ | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. London Mirror Specials
  2. অন্যান্য
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. খুলনা
  6. খেলা
  7. চট্রগ্রাম
  8. জেলার খবর
  9. ঢাকা
  10. তথ্য-প্রযুক্তি
  11. প্রবাসের কথা
  12. বরিশাল
  13. বাংলাদেশ
  14. বিনোদন
  15. ব্যাবসা-বাণিজ্য

গভীর সংকটের মুখে শিল্প খাত

প্রতিবেদক
Newsdesk
আগস্ট ১৩, ২০২২ ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

বিদ্যমান বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতি এবং ডলারের দামে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে শিল্প খাত ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে। শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়েছে।

লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প খাতে উৎপাদন কমছে। কর্মীদের বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন সক্ষমতা কমছে। কিছু ইউনিট চালু রাখতে গিয়ে নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় খরচ আরও বেশি হচ্ছে। সব মিলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এতে একদিকে পণ্যের দাম বেড়েছে।

অন্যদিকে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে কমেছে পণ্যের বিক্রি। নয় মাসের মাথায় দ্বিতীয় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এ খাতে সংকট আরও বাড়ছে। আগামীতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। এটি হবে শিল্প খাতের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।

উদ্যোক্তারা বলেছেন, গত বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ইতোমধ্যে শিল্প খাতে পড়েছে। ফলে সব শিল্পপণ্যের দাম বেড়েছে। ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব এখন পড়ছে। নতুন করে গত ৬ আগস্ট থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে ইতোমধ্যেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামী এক মাসের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রকট হবে। সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর কথা বলছে। এটি হবে শিল্প খাতের জন্য আরও বড় আঘাত।

সূত্র জানায়, করোনার সময় পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। করোনার পর হঠাৎ করে চাহিদা বাড়ায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব কাটতে না কাটতেই গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়।

এতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম আরও বাড়তে শুরু করে। গত এপ্রিল থেকে দেশে ডলারের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। এর মধ্যে গত নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম এক দফায় ২৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় বাড়ানো হয়েছে ৫২ শতাংশ। এসব কারণে শিল্প খাতে খরচ বেড়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, শিল্প খাতে এখন সংকট যেকোনো পর্যায়ে গেছে তা বলে বোঝানো যাবে না। যেভাবে খরচ বেড়েছে, সেভাবে পণ্যের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে লোকসানে পড়তে হচ্ছে। রপ্তানিমুখী শিল্পে সংকট আরও প্রকট। এখানে ইচ্ছে করলেই পণ্যের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে শিল্প খাত নিয়ে সরকারকে বসা উচিত। অন্য খাতের সঙ্গে এ খাতের তুলনা করলে চলবে না।

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে গত দেড় বছরে শিল্পের যন্ত্রপাতির দাম গড়ে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। কাঁচামালের দাম বেড়েছে গড়ে ৫০ শতাংশ। গত এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। জ্বালানি তেলের দাম দুই দফায় বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। গ্যাসের দাম একদফা বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রথম দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে পরিবহণ খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ।

উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ। এর ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এর প্রভাবে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর পণ্যের দামও বেড়েছে। দ্বিতীয় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে পরিবহণ ভাড়া বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। এর প্রভাবে ইতোমধ্যে খুচরা বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়ায় কোম্পানিগুলোকেও পণ্যের দাম আরও এক দফা বাড়াতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সব মিলে রপ্তানি খাত এখন ভয়াবহ সংকট অতিক্রম করছে। এই সংকট দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারলে ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়বে। কেননা বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো বিদ্যমান সংকট ভিন্নভাবে মোকাবিলা করছে। ফলে ওইসব দেশ বাংলাদেশের চেয়ে রপ্তানি বাজারে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে লোডশেডিং, জ্বালানি তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করলে উৎপাদন কমবে এবং খরচ বাড়বে। বাড়তি খরচ দিয়ে পণ্য বিক্রি করা যাবে না। তখন এ খাতে সংকট আরও বড় হবে। সরকারকে এ বিষয়গুলো ভাবতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম ও দেশের বাজারে ডলারের দাম বাড়ার ফলে আগে ১০০ ডলার দিয়ে যে কাঁচামাল আমদানি করা যেত তা করতে এখন লাগছে কমপক্ষে ১৫০ থেকে ১৬০ ডলার। এতেও খরচ বেড়েছে।

ডলার সাশ্রয় করতে সরকার জ্বালানি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। ফলে লোডশেডিং হচ্ছে। এতে ওই সময়ে শিল্প উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এমনিতেই বাংলাদেশের উৎপাদন সক্ষমতা কম। বাংলাদেশের গড় উৎপাদন সক্ষমতা ৪৫ শতাংশ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামে ৫৫ শতাংশ। লোডশেডিংয়ের কারণে একদিকে উৎপাদন সক্ষমতা কমেছে। অন্যদিকে কিছু ইউনিট চালু রাখতে নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। এতে খরচ আরও বেশি বেড়েছে। ফলে উৎপাদন খরচও বাড়ছে।

বাংলাদেশ বিদেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি করে। গত অর্থবছরে শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৭৮৮ কোটি ডলারের। আমদানি হয়েছে ৭১৯ কোটি ডলারের। আমদানি অপেক্ষায় রয়েছে ১৮৪ কোটি ডলারের পণ্য। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে এলসি খোলা হয়েছিল ৬১৪ কোটি ডলারের। আমদানি হয়েছিল ৫৩২ কোটি ডলার। আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে এলসি খোলা বেড়েছে ২৮ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।

এর মধ্যে কয়লা ১১৮ শতাংশ, সিমেন্ট ২৮ শতাংশ, ক্লিংকার ও লাইমস্টোন ১০ শতাংশ, টিন প্লেট ২৪ শতাংশ, পুরোনো জাহাজ ১২ শতাংশ, লোহা ও স্টিল স্ক্র‌্যাব ৫০ শতাংশ, পেপার ও পেপার বোর্ড ১৩ শতাংশ, মেটাল ৭৯ শতাংশ ও অন্যান্য মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। অর্থের হিসাবে পণ্যের আমদানি বাড়লেও পরিমাণগতভাবে আমদানি বাড়েনি। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ও দেশীয় বাজারে ডলারের দাম বাড়ার কারণে বেশি অর্থে কম পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

শিল্পের মৌলিক কাঁচামাল আমদানির জন্য গত অর্থবছরে ৩৩৪ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। আমদানি হয়েছে ২৯৮ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে ১০৪ কোটি ডলার পণ্য। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে এলসি খোলা হয়েছিল ২৪৪ কোটি ডলারের। আমদানি হয়েছিল ২০২ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে ৭১৭ কোটি ডলারের পণ্য। আলোচ্য সময়ে এলসি খোলা বেড়েছে ৩৭ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। এর মধ্যে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে ২৮ শতাংশ, আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় উদ্যোক্তারা এলসি খুলেও পণ্য দেশে আনেননি। ফলে এ খাতে অনিষ্পন্ন এলসি বেড়েছে।

এছাড়া তৈলবীজ আমদানির ২৬ শতাংশ, কাপড় ৪৪ শতাংশ, ওষুধের কাঁচামাল ৪ শতাংশ, তুলা ২৮ শতাংশ, সুতা ১০৫ শতাংশ, সিনথেটিক সুতা ৮৩ শতাংশ ও রাসায়নিক পণ্য আমদানি ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। এক্ষেত্রেও পরিমাণে কম আমদানি হয়েছে। ডলারের দাম ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় ব্যয় বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক রাজীব হায়দার বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। ডলারের দাম বাড়ায় এ খাতে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। এর সঙ্গে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ। কিন্তু রপ্তানি পণ্যের দাম বাড়াতে পারছি না। বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো কম দামে পণ্য রপ্তানি করছে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি।

সূত্র জানায়, করোনা ও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। কিন্তু এর মধ্যেও শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। এ নিয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে। গত অর্থবছরে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৬৪৬ কোটি ডলার, আমদানি হয়েছে ৫২৭ কোটি ডলার। আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে ৪৩ কোটি ডলারের পণ্য। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে এলসি খোলা হয়েছিল ৫৭০ কোটি ডলারের। আমদানি হয়েছে ৩৪৭ কোটি ডলারের। অনিষ্পন্ন রয়েছে ৩২৫ কোটি ডলারের শিল্পের যন্ত্রপাতি। আলোচ্য সময়ে এলসি খোলা বেড়েছে ১৩ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৪১ শতাংশ।

এর মধ্যে টেক্সটাইল যন্ত্রপাতি ২৪ শতাংশ, চামড়া শিল্পের এলসি খোলা বেড়েছে ১৮৬ শতাংশ। কিন্তু আমদানি কমেছে সাড়ে ৪৪ শতাংশ। চামড়া শিল্পে মন্দার কারণে নতুন বিনিয়োগ নেই। এর মধ্যে কীভাবে কোন খাতে এসব যন্ত্রপাতি এসেছে তা খতিয়ে দেখার দাবি করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে টাকা পাচার হচ্ছে। একইভাবে পাট শিল্পের এলসি খোলা ও আমদানি কমেছে। তারপরও আমদানি হচ্ছে।

এছাড়া গার্মেন্ট শিল্পের ৪৭ শতাংশ, ওষুধ শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। প্যাকিং শিল্পের ১৪ শতাংশ কমেছে। অন্যান্য শিল্পের ৪২ শতাংশ বেড়েছে। শিল্প খাতের অন্যান্য পণ্য আমদানি বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

সব খাতে খরচ বাড়ার কারণে পণ্যের দামও বেড়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি। এতে শিল্পপণ্যের বিক্রি কম হচ্ছে। ফলে শিল্প খাত আরও মন্দায় আক্রান্ত হবে।

সর্বশেষ - আন্তর্জাতিক