জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের আটটি আবাসিক হলে প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আসন (সিট) বরাদ্দের পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা–কর্মী। এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু হলগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দৃশ্যত কোনো উদ্যোগ না নিয়ে এখন বলছে, ছেলেদের নতুন তিনটি আবাসিক হলের নির্মাণকাজ শেষের দিকে। হলগুলো উদ্বোধন হলেই ছাত্রদের আবাসনসংকট কেটে যাবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখন আবাসনসংকট প্রকট। বিশেষ করে ছেলেদের হলগুলোতে তীব্র আসনসংকট চলছে। এর অন্যতম কারণ হলগুলোতে অছাত্রদের অবস্থান, আসন বরাদ্দে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ না থাকা, ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের হাতে আসন বরাদ্দের অলিখিত ক্ষমতা এবং পর্যাপ্ত হল না থাকাকে দায়ী করেছেন শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা।
তবে শুধু হল নির্মাণেই সমাধান না খুঁজে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও হলগুলোতে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঞ্চের সমন্বয়ক অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘নতুন হল বানালেই আবাসনসংকট দূর হবে না। হলগুলোতে এখনো সাবেক শিক্ষার্থীরা থাকেন। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা হলে ছায়া প্রশাসন তৈরি করছে। এসব দূর না করলে আবাসনের বিষয়টি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনা সম্ভব নয়।’
নতুন হল বানালেই আবাসনসংকট দূর হবে না। হলগুলোতে এখনো সাবেক শিক্ষার্থীরা থাকেন। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা হলে ছায়া প্রশাসন তৈরি করছে। এসব দূর না করলে আবাসনের বিষয়টি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনা সম্ভব নয়।—
অধ্যাপক রায়হান রাইন, সমন্বয়ক, শিক্ষক মঞ্চ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ অনুসারে স্নাতকোত্তর শ্রেণির মৌখিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাত দিনের মধ্যে আবাসিক হল ছেড়ে দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। মেয়েদের আটটি হলে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ থাকায় সেটি সম্ভব হলেও ছেলেদের হলগুলোতে ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া পরও অনেকেই হলে রয়েছেন।
বিভিন্ন হলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়া ৩৫ জন, আল–বেরুনী হলে ২৫ জন, শহীদ সালাম–বরকত হলে প্রায় ৩০ জন, মীর মশাররফ হোসেন হলে অর্ধশতাধিক, আ ফ ম কামালউদ্দিন হলে প্রায় ৩০ জন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ২০ জন, শহীদ রফিক–জব্বার হলে ১৫ জন, মওলানা ভাসানী হলে ৩৫ থেকে ৪০ জনের ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তাঁরা হলে থাকছেন। তাঁদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ৪৩তম ব্যাচে (২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ) পোষ্য কোটায় ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নিয়ম অনুযায়ী, পোষ্য কোটায় ভর্তি হওয়া কেউ আবাসিক হলে অবস্থান করতে পারবেন না। কিন্তু হাবিবুর রহমান ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে থাকছেন। হলটির ৩৪৭ নম্বর (চারজনের কক্ষ) কক্ষে একাই থাকেন তিনি।
এর আগে গত মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ৩৪৬ নম্বর কক্ষকে ছাত্রলীগ সম্পাদকের অলিখিত রাজনৈতিক কার্যালয় বানিয়েছিলেন তিনি। গত ২০ মার্চ অনলাইনে এ–সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হলে কার্যালয়টি বন্ধ করে দেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে হাবিবুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে দুই দফায় চার মিনিট কথা বলেছে । তবে কক্ষের বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি বারবার ব্যস্ততার অজুহাত দেখান।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ইস্রাফিল আহমেদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী পোষ্য কোটায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা হলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন; কিন্তু তাঁরা হলে আসন পান না। হাবিবুর রহমান পোষ্য কোটায় কি না আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, আবাসিক হলগুলোতে আসন বরাদ্দ দেবে সংশ্লিষ্ট হল প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের আটটি হলে এ নিয়ম বলবৎ থাকলেও ছেলেদের হলের আসন বরাদ্দ দেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছেলেদের আটটি হলে আসন বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের কথাই সেখানে শেষ কথা।