সম্মান আর গৌরবের প্রতীক বঙ্গভবন সেজেছে নতুন রূপে। বহু বছরের জরাজীর্ণ স্থাপনা তোশাখানা জাদুঘর ভেঙে সেটিকে নান্দনিক করে গড়ে তোলা হয়েছে। বিমান হামলা থেকে রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার জন্য তৈরি বিশেষ ভবনটি রূপ পেয়েছে আধুনিক স্থাপনায়, যা এত বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। তিনটি বড় পুকুর দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এক বছরের কর্মযজ্ঞ শেষে আগামীকাল মঙ্গলবার বিকেল চারটায় আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন স্থাপনা উদ্বোধন করবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
আগামী এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। বিদায়বেলা রঙিন করে রাখতে চান তিনি। মূলত তাঁর আগ্রহে বঙ্গভবনকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তার চাদরে থাকা ভবনটি সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রপতির ইচ্ছাতেই। অনলাইনে টিকিট কেটে দর্শনার্থীরা বঙ্গভবনের ভেতরের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা দেখতে পারবেন। তবে নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতির অফিস ও বাসভবন দেখার সুযোগ জনসাধারণের জন্য থাকছে না। বঙ্গভবনের ভেতরে হলেও নবনির্মিত স্থাপনাগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির অফিস ও বাসভবন বেশ দূরে। মূলত সীমিত আকারে বঙ্গভবনের একটি অংশ দর্শনার্থীদের জন্য চালু করা হবে। তবে কোন পদ্ধতিতে বঙ্গভবনে প্রবেশ করা যাবে, তার একটি ধারণা কাল অনুষ্ঠানে পাওয়া যাবে।
গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, রাষ্ট্রপতির একান্ত আগ্রহে বঙ্গভবনকে নতুন রূপে সাজানো হয়েছে। মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে নবনির্মিত স্থাপনা উদ্বোধন করা হবে। রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনের ভেতরে নবনির্মিত স্থাপনা সাধারণ মানুষকে দেখার ব্যবস্থা করে দিতে চান। মানুষ যাতে বঙ্গভবনের ভেতরে দুর্লভ জিনিস দেখতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। উদ্বোধনের পর জানা যাবে, কবে থেকে দর্শনার্থীদের বঙ্গভবনের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হবে।
১৯০৫ থেকে ১৯১১ সালে ঐতিহাসিক দিলখুশা গভর্নমেন্ট হাউস, অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশের শাসনকর্তার (লেফটেন্যান্ট গভর্নমেন্ট) কার্যালয় ও বাসভবন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর এটা ‘বঙ্গভবন’ নামে বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক রূপে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির অফিস ও বাসভবন হিসেবে এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করে।
কারা দেখতে পারবেন
দর্শনার্থীদের জন্য বঙ্গভবনের ভেতরে নতুন স্থাপনা দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বিদায়ের আগে তিনি এটির বাস্তবায়ন দেখতে চান। অনলাইনে টিকিট কেটে দর্শনার্থীরা বঙ্গভবনে প্রবেশ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফলাফল অর্জনকারী শিক্ষার্থী, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, দেশের জন্য ভালো কাজ করেছেন—এমন ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বিভিন্ন দেশের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূতেরা তাঁদের পরিচয়পত্র পেশের সময় বঙ্গভবনে তাঁদের গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদেরও নতুন স্থাপনা দেখানো হবে।
সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, বঙ্গভবনের একটি অংশ সীমিত আকারে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
কী কী দেখা যাবে
গণপূর্ত অধিদপ্তর বলছে, রাষ্ট্রপতির একান্ত আগ্রহে এক বছর আগে বঙ্গভবনের ভেতরে পুরোনো স্থাপনা ভেঙে নতুন করে নির্মাণকাজ শুরু হয়। একটি হচ্ছে তোশাখানা ভবন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফরকালে যেসব উপহারসামগ্রী পান, সেগুলো এই তোশাখানা জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয় উপহারগুলো সংরক্ষণে তোশাখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তাঁর নির্দেশে ১৯৭৪ সালে বঙ্গভবনের ভেতরে উপহারসামগ্রী সংরক্ষণের জন্য তোশাখানা ভবন নির্মাণ করা হয়। এরপর দীর্ঘ সময় ভবনটি আধুনিকায়নে আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
জরাজীর্ণ ভবনটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এবার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পাওয়া দুর্লভ উপহারসামগ্রী দেখতে পারবেন দর্শনার্থীরা। এর আগে ২০১৮ সালে রাজধানীর বিজয় সরণি এলাকায় ৮০ কোটি টাকা খরচ করে নতুন একটি তোশাখানা জাদুঘর নির্মাণ করা হয়। সেটিও জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।
শেল্টার হাউস
বিমান হামলা থেকে রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার জন্য ষাটের দশকে বঙ্গভবনের ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছিল শেল্টার হাউস। দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল ভবনটি। এটিকে ভেঙে নতুন করে সাজানো হয়েছে। পুরোনো এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিও দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখতে পারবেন।
বঙ্গভবনের ভেতরে দানা দিঘি, সিংহ পুকুর ও পদ্মপুকুর নামের তিনটি পুকুর আছে। মৎস্য বিভাগের তত্ত্বাবধানে এসব পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চাষ হয়। তিনটি পুকুর সংস্কার করা হয়েছে। এসব পুকুর দেখতে পাবে মানুষ। এ ছাড়া বঙ্গভবনের ভেতরে একটি পুরোনো ঐতিহাসিক মার্সেডিজ গাড়ির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
‘বঙ্গভবনকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্তকরণের লক্ষ্যে আধুনিকায়ন’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় এসব কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঠিক কত টাকা খরচ হয়েছে, তা জানা যায়নি।
আগামী ২৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দ্বিতীয় মেয়াদের পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে। সংবিধান অনুসারে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন। মেয়াদ অবসানের পূর্ববর্তী ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে হবে। সে হিসাবে আগামী ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হবেন, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
‘বঙ্গভবন’ হচ্ছে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও বাসভবন। এটি জাতির মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক। মূলত বঙ্গভবনের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, জনসাধারণের জন্য বঙ্গভবনের একটি অংশ খুলে দিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিকড়ের সন্ধানে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে।