আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। এরপরই নতুন ইতিহাস লিখতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎখাতে নব দিগন্তের সূচনা হতে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে নিউক্লিয়ার ক্লাবের ৩৩তম সদস্য দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দুপুর ২টায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হস্তান্তরের সার্টিফিকেট ও মডেল প্রদান করা হবে। কমিশনিং অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
কমিশনিং প্রোগ্রাম উপলক্ষ্যে ইতোমধ্যেই প্রস্তুত করা হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্প এলাকার অফিস সংলগ্ন খোলা মাঠে বিশাল প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। সামিয়ানার নিচে পাঁচ শতাধিক আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেখানে বসে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের ভার্চুয়াল বক্তব্য দেখা ও শোনা যাবে। সাক্ষী হওয়া যাবে অবিস্মরণীয় এক মুহূর্তের।
সরেজমিনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে বসানো হয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের ছবি। এছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির পাশাপাশি স্মারক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ চুক্তির নানা ছবি।
জানা গেছে, পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরের বছর ১৯৬২ সালে বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার রূপপুরে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের স্থান নির্ধারিত হয়। এরপর নানা সমীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই করে ২৯২ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। এরমধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য বরাদ্দ ছিল ৩২ একর জমি। সাত বছরে ভূমি উন্নয়ন, অফিস, রেস্ট হাউজ, বৈদ্যুতিক উপ-কেন্দ্র ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণকাজ আংশিক সম্পন্ন হলেও ১৯৬৯ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে পুনরায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে বঙ্গবন্ধুর সরকার। তবে ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তা আবারও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৭৭-১৯৮৬ সালে ‘মেসার্স সোফরাটম’ কর্তৃক সম্ভাব্যতা যাচাই করে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ১২৫ মেগাওয়াটের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদিত হয়। তবে সেবারও প্রকল্প বাস্তবায়ন মুখ থুবড়ে পড়ে।
১৯৮৭-৮৮ সালে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দুটি কোম্পানি দ্বিতীয়বার সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ওই স্টাডির মাধ্যমে প্রকল্পের আর্থিক ও কারিগরি যৌক্তিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ স্টাডিতে ৩০০-৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় এলে গতি পায় প্রকল্পের কাজ। ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগ সরকার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। সেসময় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া মানবসম্পদ উন্নয়নসহ কিছু প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্ল্যান-২০০০ অনুমোদিত হয়।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এসে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অপরিহার্য কার্যাবলি সম্পাদন’ শীর্ষক উদ্যোগ নেয়। উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যাবলি ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৯ সালের ১৩ মে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশান ফেডারেশনের স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশনের (রোসাটোম) মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এর এক বছর পর তারা একটি ‘ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি’ সই করেন।