বাংলাদেশকে তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্যে যে মনোমালিন্য শুরু হয়েছে, তাতে বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখে কেন্দ্র পানি বিক্রি করতে চাইছে বলে মততা যে অভিযোগ তুলেছেন তাকে ‘মিথ্যা’ বলে আখ্যা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আর মমতার সরকার বলছে, কেন্দ্র কিছুই জানায়নি।
দ্বিপাক্ষিক সফর শেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে যাওয়ার পরই সোমবার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে নিশানা করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠিও পাঠিয়েছেন তিনি। তার অভিযোগ, রাজ্যের সাথে কোনো আলোচনা না করেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশকে পানি বিক্রি করতে চাইছে। এমনকি হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা বলেছেন, কেন্দ্র যদি একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তার প্রতিবাদে গোটা দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
মমতার এমন বক্তব্যের চব্বিশ ঘন্টা না যেতেই মঙ্গলবার মমতার এই দাবিকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আগেই অবহিত করা হয়েছিলো। কেন্দ্রীয় সরকার সূত্রের খবর, গত বছরের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চিঠি লিখেছিলো কেন্দ্র। তাতে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির নবায়নের বিষয়ে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা করার জন্য গঠিত কমিটিতে রাজ্যের তরফে মনোনীত প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছিলো। ওই বছরেরই ২৫ আগস্ট রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কমিটির জন্য রাজ্যের সেচ ও জলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রকৌশলীকে (নকশা ও গবেষণা) মনোনীত করা হয়। চলতি বছরের ৫ এপ্রিল রাজ্য সরকারের সেচ ও জলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব চিঠি দিয়ে ফারাক্কা বাঁধের ভাটির অংশ থেকে পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য তাদের মোট পানির চাহিদার বিষয়টি জানিয়েছিলেন।
সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা এএনআইও জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার মিথ্যা দাবি ছড়িয়েছে যে, ফারাক্কায় গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনাতে তাদের সাথে পরামর্শ করা হয়নি।
মঙ্গলবার দিনভর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এবং কেন্দ্রীয় প্রচারমাধ্যমে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিস্তা গঙ্গা পানি চুক্তি সম্পর্কে রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে দেওয়ার দাবিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন দাবি করা হচ্ছে তখন ফের ময়দানে নামেন মমতা। নিজে প্রকাশ্যে না এলেও সচিবালয় নবান্ন থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার হয়ে রাজ্যের এই জ্যেষ্ঠ আমলা দাবি করেন রাজ্য, দেশ এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লিখিত জানিয়েছেন।
আলাপন বলেন, সোমবার লেখা চিঠির আগে ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর, ওই বছরেরই ২১ ফেব্রুয়ারি এবং তারও আগে ২০১৭ সালের ২৫ মে চিঠি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সবকটি চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশ পানি বণ্টন বহু বছরের একটি বিষয়। যার উপরে নির্ভর করে কোটি কোটি মানুষের জল পাওয়ার ইস্যু। এর উপর নির্ভর গঙ্গার ভাঙনজনিত সমস্যাবলি। এছাড়াও এর উপর নির্ভর করে আমাদের কৃষি, সেচ, পানীয় জল প্রভৃতি বিষয়।
তিনি বলেন, কেন্দ্র যে বিষয়টিকে রাজ্য সরকারকে অবগত রেখে করা হয়েছে বলে দাবি করছে সেটি হলো গত বছরের ২৪ জুলাই জলশক্তি মন্ত্রণারয়ের একটি ১২ সদস্যের টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে। তাতে একজন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে রাখা হয়েছিলো বলে আলাপন দাবি করেন।
আলাপন বলেন, এরপর গত ১৪ জুন সেই কমিটি কেন্দ্রীয় জল কমিশনকে তাদের রিপোর্ট দেয়। যা জলশক্তি মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে। তাদের দাবি, রাজ্য সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মত দিয়েছেন।
কিন্তু, এ ব্যাপারে ‘দুএকটি ছোট ইনপুট’ ছাড়া আর কিছু চাওয়া হয়নি বলে দাবি জানান মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা।
অথচ মুখ্যমন্ত্রী মমতার সাম্প্রতিক লেখা চিঠিতে যেভাবে উত্তর ও মধ্যবঙ্গ থেকে যে সমস্ত নদী বাংলাদেশে যায়, এবং নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত গুচ্ছ সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। তা এই রিপোর্টে বিন্দুবিসর্গ নেই বলে জানান আলাপন।
তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, জলশক্তি মন্ত্রণালয় এই কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কোনো চিঠি দেয়নি। কোনো যোগাযোগ করেনি। কোনো আলোচনাও করেনি।
আলাপন আরও বলেন, মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পানি বণ্টন নিয়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন সেসবের কিছুই জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের নজরে ছিলো না। তারা সে সম্পর্কে রাজ্য সরকারকে কোনো কিছুই জানায়নি।
তিনি বলেন, কেন্দ্র ও রাজ্যে নীতি নির্ধারক কোনো কমিটিতেই ভারত-বাংলাদেশ পানি চুক্তি নিয়ে কোনো কথা বা আলোচনা হয়নি।
এদিকে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তিস্তা-গঙ্গা পানি চুক্তি ইস্যুতে উত্তপ্ত হতে চলেছে ভারতের চলমান সংসদ অধিবেশন। তৃণমূল কংগ্রেস সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের স্বার্থ উপেক্ষা করে তিস্তা-গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরে সামান্যতম পদক্ষেপ নিলে দেশজুড়ে গণ আন্দোলনের পাশাপাশি সংসদের ভিতরেও তীব্র প্রতিবাদের প্রস্তুতি নিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলটির দাবি, নি চুক্তি ইস্যুতে একাধিক বিজেপি বিরোধী দলের সমর্থন পাচ্ছেন তারা।
শনিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা দেন, ২০২৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে। তা নবায়নের জন্য উভয় দেশের বিশেষজ্ঞরা আলোচনা শুরু করবে। একইসঙ্গে তিনি জানান, তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্প সমীক্ষার ব্যাপারে ভারতের একটি কারিগরি দল খুব শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।
এদিকে মঙ্গলবার ভারত সফর নিয়ে গণভবনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে মমতার আপত্তির প্রসঙ্গ উঠে আসে সাংবাদিকদের প্রশ্নে।
উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, তিস্তায় আমরা প্রজেক্ট নিয়েছি। পুরো নদীটাকে ড্রেজিং করা, পাড় বাঁধানো, পানি সংরক্ষণ, সমস্ত বিষয় সেখানে আলোচনা হয়েছে এবং তিস্তা এবং গঙ্গার জন্য, বিশেষ করে গঙ্গা চুক্তির জন্য, ২০২৬ সালে ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে, এরপর এটা যদি নবায়ন নাও হয়, চুক্তি কিন্তু অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, তবে যেহেতু ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তির মেয়াদটা শেষ হবে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, একটা টেকনিক্যাল গ্রুপ করা হবে। যেটা মমতা ব্যনার্জি বলেছেন, উনার ক্ষোভ যে উনার সঙ্গে আলোচনা করেনি, উনি তো ছিলেন না দিল্লিতে। আমি নিজেই তো যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, উনি ছিলেন না। থাকলে নিশ্চয় উনাকে নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। অন্তত আমি করতাম।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৩০ বছরের জন্য গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীসাংসিত এই বিষয়টি নিয়ে একটি সুরাহায় আসে। দিল্লিতে ছিলো এইচডি দেবগৌড়ার যুক্তফ্রন্ট সরকার। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সে সময় পানি বণ্টন চুক্তিকে সমর্থন করেন।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে দুই দেশের পানি সম্পদ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তির বিষয়ে দুইপক্ষ একমত হয়েছিলো। মনমোহন সিংয়ের সফরেই বহু প্রতীক্ষিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় তা আটকে যায়।
নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসার পর তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশার কথা শোনা গেলেও মমতার মত বদলায়নি।