বুধবার , ৯ অক্টোবর ২০২৪ | ৬ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. London Mirror Specials
  2. অন্যান্য
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. খুলনা
  6. খেলা
  7. চট্রগ্রাম
  8. জেলার খবর
  9. ঢাকা
  10. তথ্য-প্রযুক্তি
  11. প্রবাসের কথা
  12. বরিশাল
  13. বাংলাদেশ
  14. বিনোদন
  15. ব্যাবসা-বাণিজ্য

যুক্তরাজ্যে বসুন্ধরা পরিবারের হাজার কোটি টাকার ২৬ সম্পত্তি

প্রতিবেদক
Newsdesk
অক্টোবর ৯, ২০২৪ ১০:৩৯ অপরাহ্ণ

রাজধানী ফার্মগেটে ছোট একটি দোকানে কম্পিউটারের পার্টস বিক্রি করতেন সবুর খান। এক পর্যায়ে অলাভজনক সেবামূলক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পান। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া টিউশন ফির অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ব্যয় না করা, সেই অর্থ নানান কৌশলে অনত্র্য স্থানান্তর-বিনিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বজনদের নিয়োগ, সরকারি জমি দখল, কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থপাচার করে বাড়ি-ব্যবসা, কী করেননি সবুর খান? আর এসব করতে গিয়ে তিনি নানান সময় নিয়েছেন নানান কৌশল, প্রতারণার আশ্রয়।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপঢৌকন আর তেলবাজি। সব মিলিয়ে সরকার, আইন ও প্রশাসনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি সবুরের শত-শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার এই গল্প যেন সিনেমাকেও হার মানায়। ফার্মগেটের গিঞ্জি গলির চতুর সবুর খান এই প্রতারণার শুরুটা অবশ্য করেছিলেন, যার সহযোগিতায় যৌথভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সনদ নিয়েছিলেন, সুযোগ বুঝে তাকে বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

সবুর খানের উত্থানের শুরু

সবুর খান বর্তমানে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান, ঢাকা চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) পরিচালক ও সাবেক সভাপতি মো. সবুর খান।

জানা যায়, প্রথম জীবনে কম্পিউটারের পার্টস বিক্রির ব্যবসা করতেন। বিএনপি সরকারের আমলে তিনি খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ও তৎকালীন বিএনপির প্রভাবশালী নেতা শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিনের বদৌলতে যৌথভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু ১/১১ এর পটপরিবর্তনের পর বিএনপির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিণ্নের ঘোষণা দেন। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসির) ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাস করা রেজ্যুলেশনে বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টির অন্যতম সদস্য বিএনপির নেতা তুহিন বিদেশে চলে যান। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড থেকে অবৈধভাবে তাকে (তুহিন) বাদ দিয়ে ইউজিসি থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুনরায় রেজ্যুলেশন বের করেন সবুর খান। এরপর থেকেই দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতারণার শুরু সবুর খানের।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো এটিকে দাতব্য প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ বোর্ড অব ট্রাস্টিজের অধীনে প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে হবে। এছাড়াও সিন্ডিকেট, একাডেমিকসহ আরো বেশ কিছু কমিটি থাকবে। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই অলাভজনক এবং দাতব্য মডেলে পরিচালনা করতে হবে। এসব শর্ত থাকা সত্ত্বেও শুরুতেই সবুর খান মনোযোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র নিজের আত্মীয় স্বজনদের নিয়োগ দেওয়ায়।

ড্যাফোডিল যেন পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়

বর্তমানে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি পরিচালনার জন্য ১১ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড রয়েছে। এতে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন সবুর খান। পাশাপাশি তার স্ত্রী সাহানা খান ভাইস চেয়ারম্যান, মেয়ে সামিহা খান, বোন রওশন আরা বেগম এবং শ্যালক মো. ইমরান হোসেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় হবে অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ট্রাস্ট আইন অনুসারেও ট্রাস্টের কোনো সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে সুবিধা নিতে পারবেন না। কিন্তু ট্রাস্ট্রি বোর্ডে থাকা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। যেখান থেকে তারা মাসে মাসে বেতন-ভাতা নেন। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় সম্মানীর নামে অর্থ গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে কারও কারও বিরুদ্ধে। যদিও আইন অনুযায়ী তাদের এসব সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়টি সূত্রে জানা যায়, সবুর খানের এক শ্যালক ইমরান হোসেন বোর্ড অব ট্রাস্টিতে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দখলে রেখেছেন ডিরেক্টর (প্রশাসন) পদ। তাকে সবাই অগোচরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পাওয়ার হাউস’ বলেই ডাকেন। ডিরেক্টর পদে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির পুরো প্রশাসন চলে তারই ইশারা ইঙ্গিতে। রেজিস্ট্রার নাদির বিন আলি রয়েছেন নামকাওয়াস্তে। নিয়োগ থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী সবকিছুই ইমরানের নিয়ন্ত্রণে। অপর শ্যালক সাব্বির আহমেদ রয়েছে পরিচালক (উন্নয়ন) পদে। পরিচালক (অ্যাকাউন্টস) হিসেবে আছেন ভগ্নিপতি মমিনুল হক মজুমদার। প্রভাবশালীদের মধ্যে আরও রয়েছেন খালাতো ভাই নাজিম। তিনি ডেপুটি পরিচালক (উন্নয়ন) হিসেবে আছেন। এছাড়া রেজিস্ট্রার অফিস, একাডেমিক কমিটি এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যানের আত্মীয়-স্বজনকে। এদের মধ্যে মামা আর চাচার পরিবারের স্বজনরাও রয়েছেন।

জানা যায়, সবুর খান মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি এবং পরিচালক পর্ষদে স্বজনদের রেখে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অনিয়মের আখড়া হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়েই রয়েছে আত্মীয় আর সবুর খানের নিজ জেলা চাঁদপুরবাসীর প্রাধান্য। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নামকাওয়াস্তে একজন উপাচার্য, রেজিস্ট্রারার এবং ট্রেজারার রয়েছেন। কারো হাতেই তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। সবকিছুতেই তাদের ধর্ণা দিতে হয় সবুর খানের শ্যালক ইমরানের কাছে। ইমরান এবং মমিনুল হক মজুমদাররা নির্ধারণ করেন কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে। কেনাকাটা ও অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ করেন ইমরান ও সাব্বির। আর সেসবে ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে স্বাক্ষর করেন ট্রেজারার হামিদুর রহমান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কমিটি হলে তাতেও অবধারিতভাবে ইমরান শীর্ষে থাকেন। বাকি বিভিন্ন অনুষদের ডিন বা সিনিয়র শিক্ষকরা থাকেন সদস্য হিসেবে।

সর্বত্র আত্মীয়করণের নেপথ্য কারণ

মূলত এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র আত্মীয়করণের পেছনে উদ্দেশ্য ছিলো প্রতারণার এক বিশাল মহাযজ্ঞ গড়ে তোলা। আর তাই ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকেই আয় ব্যয়ের হিসেবে স্বচ্ছতা ছিল না। এখানে টাকা সরানোর কাজটি সব সময় করে এসেছেন হিসাব শাখার কর্মকর্তা চেয়ারম্যানের মামাতো ভাই রাসেল প্রধানিয়া।

এই পুরো প্রতারণা ব্যবস্থায় চতুরভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় কম দেখানো ও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া হয়। প্রতি সেমিস্টারে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধু তিন ভাগের এক ভাগের হিসাবটাই ইউজিসি বা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় তারা। ইউজিসির নীতিমালা অনুসারে ল্যাব সংশ্লিষ্ট কোর্সে মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানোর অনুমোদন থাকলেও, ড্যাফোডিলে প্রতি সেমিস্টারে শুধু সিএসই কোর্সেই ভর্তি করানো হয় হাজারের উপর শিক্ষার্থী।

সরকারি জমি দখল

এখানেই শেষ না, আশুলিয়ায় যে জমিগুলোর উপর বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত তা ছিল এক সময় ভাওয়াল রাজার সম্পত্তি। পরবর্তীতে এগুলো বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগের অধীনে চলে আসে। আশুলিয়ার দত্তপাড়ার এলাকার ওই সব সরকারি জমি পরিত্যক্ত ছিল। কিছু ছিল যেখানে স্থানীয়রা চাষাবাদ করতো।

২০১৩ সালের পরে সেসব জমি দখল করে একটু একটু করে গড়ে উঠতে থাকে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ, অডিটোরিয়াম, চারটি হোস্টেল, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বাসভবন, গলফ ক্লাব, শহীদ মিনার, বিভিন্ন ল্যাবরেটরি, ক্যাফেটেরিয়া, একাডেমিক ভবন, বিভিন্ন নান্দনিক স্থাপনাসহ কয়েকশো একর জমির উপর স্থাপিত বিশাল ক্যাম্পাসটির বেশিরভাগ অংশ সরকারি বনবিভাগের জমিতেই গড়ে উঠেছে।

অভিযোগ রয়েছে, সরকারি জমি উদ্ধারে বিগত বছরগুলিতে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে বারবার বন্ধ হয়ে গেছে।

ড্যাফোডিল পরিবার সবুরের আরেক প্রতারণার জাল

এদিকে, প্রতারণার মহাযজ্ঞকে বাস্তবায়ন করতে সবুর খান প্রতিষ্ঠা করেন ড্যাফোডিল পরিবার নামে প্রতিষ্ঠান। গ্রুপ অব কোম্পানির আদলে এই ড্যাফোডিল পরিবারে রয়েছে অঙ্গ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে—ডিসিএল, ওভাল ফার্নিচার, ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল, সবুজ প্রিন্টার্স, ডিওএল, বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল লিঃ, স্কিল জবস, গ্রিন গার্ডেন, ড্যাফোডিল এডুকেশন নেটওয়ার্ক ইত্যাদি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোক্ষেত্রেই উম্মুক্ত টেন্ডার আহ্বান করা হয় না। মূলত এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই ফলস টেন্ডার সাবমিশনের মাধ্যমে কাজ পায় ড্যাফোডিল পরিবারেরই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে বাজার মূল্যের থেকে বেশি দামে পণ্য কিংবা সেবা দেখিয়ে মূলত সরানো হয় বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডে জমা পড়া শিক্ষার্থীদের টাকা।

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয় একটি করে ল্যাপটপ। এই ল্যাপটপের টাকাটি আসে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে। আর বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে টাকা আসে মূলত শিক্ষার্থীদের জমা করা সেমিস্টার ফিস থেকে। ল্যাপটপ দেওয়ার এই কাজটি মূলত করে ডিসিএল তথা ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স লিমিটেড। সস্তা চাইনিজ পার্টসকে এসেম্বেল করে বানানো ১০-১৫ হাজার টাকার ল্যাপটপকে দেখানো হয় ৭০-৮০ হাজার টাকার উপরে।

সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ফার্নিচারসহ ইন্টেরিয়রের কাজ করে ওভাল ফার্নিচার। প্রিন্টিং ও প্রেসের সমস্ত কাজ করে সবুজ প্রিন্টার্স। ইন্টারনেট প্রভাইডিংয়ের কাজ করে ডিওএল। বিভিন্ন ইভেন্টে ক্যাটারিংয়ের কাজ করে গ্রিন গার্ডেন। সবগুলো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই মূলত অপ্রদর্শিত অর্থকে সাদা করা হয় এবং বাড়তি খরচ দেখিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা আকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা তছরুপ করা হয়। স্কিল জবসের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন নিয়োগ আয়োজনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা ড্যাফোডিল পরিবারের অন্য কোম্পানিতে স্থানান্তর করা হয়।

অন্যদিকে হলগুলো পরিচালনা করে ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল। এই ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের নামে শিক্ষার্থীদের হলের অর্থ আত্মসাতে সবুর খান এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।

বনবিভাগের জমিতে ছাত্রাবাস

সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে আরো জানা যায়, শিক্ষার্থীদের হোস্টেলের নামে টাকা সরানো হয়। এই হলগুলো মূলত তৈরি করা হয়েছে সরকারি বনবিভাগের জমিতে। শিক্ষার্থীদের আবাসন হওয়ার কারণে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ সহজে এগুলো দখল করতে আসবে না—এই চিন্তা থেকে তারা হলগুলোতে খেলার মাঠ থেকে শহীদ মিনার ইত্যাদি বিভিন্ন কিছু স্থাপন নির্মাণ করেছে।

এ বিষয়ে ড্যাফোডিলের সঙ্গে দীর্ঘদিন করেছেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘এই হলের নির্মাণ খরচ, আসবাবপত্র ক্রয় থেকে শুরু করে সকল ব্যয় করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের অর্থে। অর্থাৎ ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের কার্যত কোনো খরচ নেই। বর্তমানে সেখানে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী থাকে। প্রতি মাসে সিট ভাড়া বাবদ শিক্ষার্থীরা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে থাকে। এভাবে প্রতি মাসে প্রায় ৪ কোটি টাকার উপর শুধু হল থেকেই আসে। কিন্তু হল থেকে আদায়কৃত এই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে জমা না হয়ে জমা হয় ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনালের একাউন্টে।’

অন্যদিকে, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের স্টার্ট আপে বিনিয়োগ করার। পরবর্তীতে সেই স্টার্টআপ সফল হয়ে উঠলে জোরপূর্বক সেই স্টার্টআপকে নিজেদের অধিগ্রহণে নিয়ে নেওয়ার।

এদিকে, ড্যাফোডিল এডুকেশন নেটওয়ার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দকৃত জমিতে গড়ে তুলেছে ড্যাফোডিলের অন্যান্য লাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেমন ড্যাফোডিল স্কুল-কলেজ ইত্যাদি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও ধানমন্ডিস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ক্যাম্পাসে এখন চলছে দুবাইভিত্তিক ব্র‍্যান্ড দানউব-এর ফার্নিচারের ব্যবসা ও ডিআইআইটি নামের ট্রাস্টের বাইরের ড্যাফোডিল এডুকেশন নেটওয়ার্কের অধীনস্থ লাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত বিল্ডিংয়ে বিজিনেস ইনকিউবেটর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চালানো হচ্ছে স্টার্টআপ অফিস ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা।

বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডের টাকায় ওষুধ কোম্পানির শেয়ার ক্রয়

এখানেই শেষ নয়, যেখানে নীতিমালা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন, গবেষণা, জমি কেনা, ভবন নির্মাণে ব্যয় করার কথা, সেখানে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান এবং তার স্ত্রী-কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডের প্রায় ১৯ কোটি টাকায় নিজেদের নামে কিনেছেন একটি ওষুধ কোম্পানির প্রায় ৫৭ ভাগ মেজোরিটি শেয়ার। নভো হেলথ কেয়ার ফার্মার সিংহভাগ শেয়ারের মালিক এখন এই তিনজন।

ফার্মাসিটিক্যাল সেক্টরে এই অবৈধ বিনিয়োগের পেছনে আছে আরো বড় খেলা। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিটিক্যাল বিভাগের ফ্রেশ গ্রাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যেই এই ভেঞ্চারের সৃষ্টি। ড্যাফোডিল গ্রুপের এমন আরো অনেক ভেঞ্চার আছে যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের চাকরিক্ষেত্র তৈরি করেছে।

তবে ড্যাফোডিলের সাবেক এক কর্মকর্তার মতে, আপাতদৃষ্টে দেখা এই মহান উদ্যোগের পেছনে রয়েছে ‘ফ্রেশ গ্রাজুয়েটদের দিয়ে অতিরিক্ত সস্তায় শ্রম ক্রয়ের মতো বিষয়। এতে করে একদিকে যেমন ভেঞ্চারগুলো ফুলে ফেঁপে উঠছে, তেমনি ব্র্যান্ডিং হচ্ছে সবুর খান ও ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের।’

র‌্যাংকিং বাণিজ্য

সবুর খানের নানান কৌশলের আরেকটি হলো টাকার বিনিময়ে ড্যাফোডিলকে র‌্যাংকিংয়ে উপরের দিকে রাখা। প্রায়ই তিনি বিভিন্ন র‌্যাংকিংয়ে ড্যাফোডিল কত উচ্চতায় আছে সেটা প্রচার করেন। এই র‌্যাংকিংগুলি মূলত ‘পেইড’ রিপোর্ট, টাকা দিয়ে এগুলো করা হয়। বিভিন্ন দেশের নামসর্বস্ব কিছু প্রতিষ্ঠান এগুলি করে। তাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করার জন্য সবুর খান নিজে নানান দেশে ঘুরে বেড়ান। টাকার বিনিময়ে তাদের দিয়ে র‌্যাংকিং করান, যেখানে এমনও দেখানো হয়, বাংলাদেশে ‘বুয়েট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতেও এগিয়ে আছে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়।’

বিদেশে অর্থ পাচার

বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতি সেমিস্টারে গড়ে একশো কোটির উপর অর্থ আদায় হয়ে থাকে বলে ধারণা করেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এই অর্থের একটি বড় অংশ সবুর খান বিদেশে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর এই টাকা পাচারকে সহজতর করতেই দুবাইয়ে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন সবুর খান। সম্প্রতি আরব আমিরাতের রাস আল খাইমায় ড্যাফোডিলের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করে ছাত্র ভর্তির বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। সেখানে অন্য ব্যবসায়ও বিনিয়োগ আছে তার। এ ছাড়া পাচারকৃত অর্থে তিনি মালয়েশিয়ায় একাধিক বাড়ি ক্রয় করে সেকেন্ড হোম সিটিজেনশিপ নিয়েছেন।

একটি সূত্র জানিয়েছে, কুয়ালালামপুরে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের কাছে সবুর খানের দুটি বাড়ি আছে। তিনি আমেরিকায়ও বাড়ি কিনেছেন এবং সেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে।

ঢাকার এক দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাতে জানা যায়, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে রয়েছে ২০০ কোটি টাকার কর ফাঁকির অভিযোগ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, এতসব অনিয়ম ও প্রতরণা সে খুব সহজেই করতে পেরেছে বিগত স্বৈরাচার সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এমপির আশির্বাদের ছায়ায় থাকার কারণে। সাবেক আইসিটিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, শিক্ষামন্ত্রী দিপুমনি ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তার ছিলো ঘনিষ্ঠতা। আর সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও ঢাকার মেয়র ফজলে নূর তাপস ছিলেন সবুর খানের নিয়োগ করা প্যানেল আইনজীবী।

তেলবাজির বঙ্গবন্ধু কর্নার হয়ে গেল বাংলাদেশ কর্নার

আওয়ামী লীগকে তৈলমর্দন করতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কর্নার। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেটির নাম বদলে এখন দিয়েছেন বাংলাদেশ কর্নার। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার সঙ্গে বিমানে হুট করে দেখা হলে ছবি তুলে সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার দেন সবুর খান।

অথচ কয়েকদিন আগেই ছাত্র জনতার উপর স্বৈরাচার সরকার যখন পাশবিক অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছিলো, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটি শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় শেখ কবিরের নেতৃত্বে সেই আন্দোলনকে নসাৎ করতে নিয়েছিল নানামুখী পদক্ষেপ। সেই কমিটির অন্যতম সদস্য সবুর খান। আর সেই শেখ কবির সরকার পরিবর্তনে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আগে তার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত সবুর খানকেই সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদের দায়িত্ব দিয়ে যান।

সভাপতির পদ পেয়েই তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ট্রাস্টি বোর্ড থেকে বের করে লিমিটেড কোম্পানি মডেলে নিয়ে যাওয়ার ও কর বিলুপ্তের মতো দাবি করছেন। যাতে তাদের টাকা আত্মসাত আরেকটু সহজ হয়ে উঠে।

কথিত আছে, শুধু প্রতারণাকে সহজ করতে সবুর খান ফটোসেশন, তেলবাজি ও চাপাবাজি করে শিক্ষা উদ্যোক্তার ছদ্মবেশে বিগত প্রায় দুই যুগ ধরে সরকারি সম্পত্তি দখল, অর্থ পাচার ও শিক্ষার্থীদের দেওয়া টাকার হরিলুট করেছেন।

এসব ব্যাপারে ড্যাফোডিল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য চাওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়টির জনসংযোগ শাখার ঊর্ধ্বতন সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হাবিব কাজল এক পৃষ্ঠার একটি লিখিত বক্তব্য দেন।

সেখানে তিনি সরকারি জমি দখলের বিষয়ে বলেন, প্রতিহিংসা পরায়ণ একটি স্বার্থান্বেসী মহল দীর্ঘদিন ধরে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যাণয়ের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আশপাশের এলাকার সরকারি বা ব্যক্তিগত জমিজমা দখলসংক্রান্ত নানা রকম অপপ্রচার চালাচ্ছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরিষ্কার বক্তব্য হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারি বা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তির এক ইঞ্চি জায়গাও অবৈধভাবে দখল করেনি।  বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যা কিছু জমি জমা ব্যবহার করেছে তা আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ থেকে বৈধভাবে ক্রয় করেই তার উপর স্থাপনা তৈরি করেছে।

ওষুধ কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া লিংকেজ সম্প্রসারণ এবং শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক পরীক্ষা কাজের সুবিধার্থে বিভাগীয় প্রধান, একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটির অনুমোদনক্রমে বোর্ড অব ট্রাস্টিকে অনুরোধ করা হয় এধরনের একটি ওষধ কোম্পানি ক্রয়ের জন্য। শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক কাজের সুবিধার্থে ওষুধ কোম্পানি ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর ট্রাস্টিবোর্ড বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত আনতে আইনগত উদ্যোগ নেয়।

তবে অনুমোদনের পার্টনারসহ সবু্র খানের অর্থপাচার, র‌্যাংকিং বাণিজ্য, বিদেশে বাড়ি-ব্যবসা, বিশ্ববিদ্যালয়কে পারিবারিক করে তোলাসহ অন্যান্য অভিযোগের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেননি তিনি। আনোয়ার হাবিব কাজলের পাঠানো লিখিত বক্তব্যের শেষে বলা হয়, এ বিষয়ে যদি কারো কোনো বক্তব্য থাকে তাহলে সমস্ত দলিল ও প্রমাণাদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কছে সংরক্ষিত আছে, আগ্রহীদের সরাসরি এসে দেখার অনুরোধ করেন তিনি।

সর্বশেষ - আন্তর্জাতিক