দীর্ঘ চার বছরের আইনি লড়াই শেষে আদালতের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গেজেট প্রকাশ করলেও শপথ নিতে পারেননি কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভার নব-নির্বাচিত মেয়র আরিফুর রহমান। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল থেকে ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল বাতিল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আরিফুর রহমানকে মেয়র ঘোষণার পর সেই গেজেট প্রকাশ করে ইসি। তবে স্থানীয় সরকার বিভাগ সেই শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এর আগে, গেজেট আটকাতে খোদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আদালতে আপিল করেছিলেন। নির্বাচন কমিশন এবং আদালতের সুস্পষ্ট রায় সত্ত্বেও স্থানীয় সরকার বিভাগের এমন আচরণে হতবাক ইসি ও প্রার্থী।
জানা যায়, ভোট কারচুপি নিয়ে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভার মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী আরিফুর রহমানের পক্ষে রায় দেয় নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। আদালতের নির্দেশ মেনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গেজেটও প্রকাশ করে। কিন্তু সেই গেজেট অনুযায়ী নব-নির্বাচিত মেয়রের শপথগ্রহণ আটকে দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। নির্বাচনের ফল বাতিল করে নতুন মেয়রের নাম ঘোষণার পরও কেবল প্রশাসক পদে থাকার ‘লোভে’ ইউএনও’র আপিলের পর এবার স্থানীয় সরকারের শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানানোয় ইসি ও আদালতের রায় প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর ২১ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের শপথের জন্য গেজেট করে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভা, সিলেটের জাকিগঞ্জ ও পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া পৌরসভার মেয়র পদে গেজেট করে নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং নীলফামারী, মাদারীপুর ও মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের সদস্য পদের গেজেট করে ইসি। এর মধ্যে কতগুলোর শপথ হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়নি বলে জানা গেছে।
আইন কী বলে?
স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ এর পঞ্চম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, মেয়র এবং কাউন্সিলরদের নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার ২০ দিনের মধ্যে সরকার বা তৎকর্তৃক মনোনীত কর্তৃপক্ষ মেয়র ও সব কাউন্সিলরকে শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করবে।
মেয়রের বক্তব্য
মেয়র আরিফুর রহমান জানান, তিনি ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি মিরপুর পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে মারধর করে মৃতপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ফলাফলে তাকে পরাজিত ঘোষণা করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেন এবং পরে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর চলতি বছরের গত ২৭ এপ্রিল আরিফুর রহমান মেয়র হিসেবে রায় পান।
আরিফুর রহমান বলেন, রায়প্রাপ্তির গেজেটের জন্য ইসির সিনিয়র সচিব বরাবর গত ৪ মে আবেদন করেন। পরবর্তী সময়ে তার গেজেট এবং রায় ঠেকাতে অনৈতিকভাবে গত ৮ মে নির্বাচনী আপিল ট্রাইবুনাল আপিল করে। কুষ্টিয়ার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা, মিরপুর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা আপিল করেন। কিন্তু জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা ২০ মে ইসিকে চিঠি দিয়ে জানান, তারা এই আপিলে স্বাক্ষর করেননি এবং অবগতও নন। পরে আপিলে যথাযথ প্রমাণ না পাওয়ায় এবং বাদী পক্ষ উপস্থিত না হওয়ায় নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং অতিরিক্ত জেলা জজ (২য় আদালত), কুষ্টিয়া মামলাটি চলতি বছরের ১২ আগস্ট খারিজ করে দিয়ে আমার পক্ষে রায় দেন।
সেই রায়ের আলোকে তিনি গত ১০ সেপ্টেম্বর মেয়র হিসেবে গেজেট পান এবং নির্বাচন কমিশন শপথ নেওয়ার জন্য গত ২৫ সেপ্টেম্বর খুলনার বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি দেয়। কিন্তু তার আবেদন করা সত্ত্বেও খুলনা বিভাগীয় কমিশনার গত ২২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের মতামত চেয়ে চিঠি পাঠান। পৌরসভা আইন অনুযায়ী গেজেট প্রকাশের ২০ কার্যদিবসের মধ্যে শপথ পড়ানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব শপথ পড়ানোর সুযোগ নেই বলে মতামত দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ক্ষমতার লোভে আদালতের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট থাকলেও সেগুলো স্থানীয় সরকার বিভাগ আমলে নিচ্ছে না। স্থানীয় সরকার বিভাগ কোন ক্ষমতাবলে শপথ পড়াচ্ছে না সেই আইনও উল্লেখ করেনি। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন বলেও জানান আরিফুর রহমান।
ইউএনও’র আপিল ও কল রেকর্ড
এর আগে নির্বাচন কমিশনের সচিব কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভার মেয়র পদের গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা দিলেও তার নির্দেশনা আমলে নেননি মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল ইসলাম এবং জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান। ইসির পরামর্শ ছাড়াই ইউএনও এবং ডিসি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশে নির্বাচনী আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করেছেন। আপিলকারী হিসেবে কুষ্টিয়া জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করা হলেও তিনি কিছুই জানতেন না। স্ব-প্রণোদিত হয়ে ইউএনও আপিল করেছেন বলেও জানান জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। অথচ নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ ছাড়া নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ে কারোই আপিল করার সুযোগ নেই বলে জানায় ইসি।
সংরক্ষিত উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার এক মোবাইল কল রেকর্ড থেকে জানা যায়, ইউএনও নাজমুল গেজেট প্রকাশ আটকাতে উপজেলা নির্বাচন অফিসারকে কিছু কাগজপত্র সরবরাহও করতে বলেন। উপজেলা নির্বাচন অফিসার আরিফুর রহমানকে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে গেজেট আটকানোতে ইউএনও’র সব প্ল্যানের কথা জানান এবং “ফরম-চ” দিয়ে সাহায্য করতে বলেন।
রেকর্ডে উপজেলা নির্বাচন অফিসারকে বলতে শোনা যায়, পাঁচবছর মেয়াদ চলে গেলে তো সে (আদালতের আদেশে যিনি মেয়র হয়েছেন) আর মেয়র হতে পারবে না। … আমরা চাচ্ছি যেভাবে চলছে, চলুক তারপর নতুন নির্বাচন হয়ে ঝামেলা মিটে যাক। পুরোনো আরেকজনকে এনে ওই পদটাতে বসাতে চাচ্ছি না।
আরিফুর রহমানের এক প্রশ্নে উপজেলা নির্বাচন অফিসার বলেন, ইউএনও আপনার হয়ে আপিল করেছে। ইউএনও আপিল করে স্থগিদাদেশ নিয়ে এসেছে। তিনি চাচ্ছেন না নতুন মেয়র আসুক। এজন্য উনি আপনার হয়ে আপিল করেছেন। আমরা এটা না আটকালে উনার গেজেট হয়ে যাবে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের মতামত ও পরবর্তী পদক্ষেপ
খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের চিঠি পাঠানোর প্রায় এক মাস পর জবাব দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ কবির উদ্দীন। তিনি বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠিতে জানান, স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৪ এর ধারা ৩২ক অনুযায়ী সরকার কর্তৃক ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র এবং কাউন্সিলরদের অপসারণপূর্বক… উক্ত পৌরসভার স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে জনস্বার্থে প্রশাসক এবং সহায়ক কমিটি নিয়োগ করা হয়েছে।
‘এই অবস্থায়, কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার মিরপুর পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচনে নির্বাচিত ঘোষিত প্রার্থীর ১০ সেপ্টেম্বরের গেজেটে প্রকাশিত সংশোধিত বিজ্ঞপ্তির আলোকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই মর্মে নির্দেশক্রমে অবহিত করা হলো।’
খুলনার স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ও পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) আবু সায়েদ মো. মনজুর আলম বলেন, নির্বাচন কমিশনের চিঠি পাওয়ার পর আমরা স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছে মতামত জানতে চিঠি দিয়েছিলাম। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে শপথ পড়ানো যাবে না মর্মে মতামত দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মতামতের ওপর আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
তিনি বলেন, শপথ না হওয়ায় ইতোমধ্যেই কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর পৌরসভার প্রার্থী আদালতে মামলা করেছে। আমরা মামলার কপি পেয়েছি এবং কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কাছে মামলার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের পৌরসভা-১ শাখার যুগ্মসচিব মোহাম্মদ কবির উদ্দীন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীতেএই প্রতিবেদক একাধিক ফোন করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
আইনি বিশেষজ্ঞদের অভিমত
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ড. মো. শাহজাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনসংক্রান্ত আইনি জটিলতা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ নিয়ে আইনি ব্যাখ্যা আছে। নির্বাচন কমিশন কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধির বিষয়ে গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর, তার নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মামলা চলমান থাকার কারণে যদি সেই প্রতিনিধির মেয়াদের প্রায় পুরোটাই চলে যায়, এমনকি মাত্র এক সপ্তাহ, ১০ দিন বা দুই দিনও হাতে থাকে তবুও তাকে স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে শপথ করাতে বাধ্য থাকবে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে শপথ করানোর দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। এই গেজেটটি একটি ম্যান্ডাটরি অর্ডার হিসেবে কাজ করে। গেজেট প্রকাশের পরও যদি জেলা প্রশাসন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে শপথ গ্রহণ না করায়, তবে এটি গুরুতর আইনি লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। সেক্ষেত্রে শপথ গ্রহণের জন্য আদালতের মাধ্যমে ম্যান্ডাটরি অর্ডার জারি করা যেতে পারে, এমনকি আদালত অবমাননা মামলাও করা যেতে পারে।
নির্বাহী আদেশ বনাম আদালতের আদেশ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে এ আইনজীবী বলেন, দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর ভিত্তিতে নির্বাহী আদেশের চেয়ে আদালতের আদেশ সব সময়ই বড় এবং চূড়ান্ত। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন। সংবিধান অনুযায়ী, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তই প্রাধান্য পাবে। যদি কোনো নির্বাহী আদেশে আদালতের কোনো রায় বা আদেশ বাতিল করার চেষ্টা করা হয়, তবে তা আইনিভাবে অকার্যকর হবে। নির্বাহী আদেশ কখনও আদালতের আদেশকে বাতিল করতে পারে না।
আইনি ভিত্তির ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আদালতের আদেশ মেনে চলতে নির্বাহী বিভাগ, এমনকি স্থানীয় সরকার বিভাগও সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। আদালতের রায়ের বিপরীতে গিয়ে নির্বাহী আদেশ জারি করে কোনো কিছু বাতিল করার ক্ষমতা স্থানীয় সরকার বিভাগ বা কোনো নির্বাহী কর্তৃপক্ষ রাখেন না। যদি কেউ এমন দাবি করেন, তবে তা আইনের পরিপন্থি। নির্বাহী কর্তৃপক্ষের উচিত আদালতের আদেশকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা।


















