চট্টগ্রাম কাউন্টারে ট্রেনের টিকিট না থাকলেও বেশি দামে মিলছে কালোবাজারিদের কাছে। তবে কালোবাজারিদের এসব টিকিট কৌশলে সরবরাহ করছে রেলওয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। বুধবার (৩০ মার্চ) রাতে রেলওয়ে থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার ফয়সাল ও মজনু মিয়া নামে দুই ব্যক্তি এমন তথ্য দিয়েছেন। একই সঙ্গে অনুসন্ধানে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ জানায়, চাঁদপুরগামী সাগরিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের ১৬৫ টাকার একটি টিকিট ৩০০ টাকায় বিক্রির সময় ফয়সালকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে ছয়টি টিকিট উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার ফয়সাল জানান তাকে এসব টিকিট দিয়েছেন মজনু মিয়া নামে এক ব্যক্তি। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দিন রাতে স্টেশন এলাকা থেকে মজনু মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মজনু মিয়া জানিয়েছেন, রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব টিকিট বিক্রির জন্য তাকে দিয়েছেন। তবে ওসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম তিনি রেলওয়ে পুলিশকে জানাননি।
চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মহাসড়কে যানজটসহ নানা ভোগান্তির কারণে ট্রেনই চট্টগ্রামের যাত্রীদের প্রথম পছন্দ। চট্টগ্রাম রেলস্টশন কাউন্টারে ট্রেনের টিকিট তেমন একটা পাওয়া যায় না। এমনকি টিকিট যেদিন দেওয়া হয় ওই দিন এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। তবে কালোবাজারিদের কাছে বেশি টাকায় ট্রেন ছাড়ার আগের দিনও টিকিট পাওয়া যায়। এসব টিকিট কালোবাজারিদের সরবরাহ করেন রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।’
গত ৯ মার্চ কোতোয়ালি থানার স্টেশন রোড এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর আলম নামে এক টিকিট কালোবাজারিকে গ্রেফতার করে সিএমপির গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের ২০টি আসনের টিকিট জব্দ করা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আলী বলেন, ‘জাহাঙ্গীর দীর্ঘদিন ধরে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে আসছিল। এই চক্রে জড়িত বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের কাউন্টারে টিকিট না থাকলেও মিলছে কালোবাজারিদের কাছে। রেলওয়ে স্টেশনের ভেতরে ও বাইরে বিভিন্ন চায়ের দোকান এবং পানের দোকানে বিক্রি হচ্ছে টিকিট। শুধু তাই নয়, নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজারের কিছু ব্যবসায়ীর কাছেও মিলছে টিকিট। এছাড়া টিকিট কালোবাজারিতে স্টেশনের বুকিং ক্লার্ক, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী, রেলওয়ে পুলিশ, আনসার ও স্টেশন এলাকায় কর্মরত অসাধু রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত আছে।
তবে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের দাবি, তাদের কেউ টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত নন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন তারা।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার রতন কুমার চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামে এখন ট্রেনের টিকিটের খুব বেশি চাহিদা। যে পরিমাণ ট্রেনে আসন আছে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি টিকিটের চাহিদা আছে। টিকিটের অতিরিক্ত চাহিদাকে পুঁজি করে কালোবাজারি বেড়েছে। বুকিং ক্লার্ক কিংবা রেলের কোনও কর্মকর্তা কালোবাজারিদের টিকিট দিচ্ছেন কিনা আমরা সে ব্যাপারে নজর রাখছি। রেলওয়ের কারও সঙ্গে টিকিট কালোবাজারিদের সংশ্লিষ্টতা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চট্টগ্রাম স্টেশনের আট কাউন্টারে টিকিট দেওয়া হয়। টিকিট বিক্রিতে আছে ৩০ জন বুকিং ক্লার্ক। টিকিটের ৫০ শতাংশ দেওয়া হচ্ছে অনলাইনে। বাকি ৫০ শতাংশ মিলছে কাউন্টারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘১০টি আন্তঃনগর ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম ছয়টি, দুটি সিলেট, একটি ময়মনসিংহ ও একটি চাঁদপুরে চলাচল করে। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নাজিরহাট, দোহাজারি, ঢাকা, সিলেট, চাঁদপুর ও ময়মনসিংহে বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেন চলাচল করে।’
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ইতি ধর বলেন, ‘ট্রেনের টিকিটের চাহিদা অনেক বেড়েছে। যাত্রীদের পর্যাপ্ত টিকিট সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। টিকিটের বেশি চাহিদাকে পুঁজি করে রেলের কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী কালোবাজারিতে জড়ালে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম রেলওয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. হাসান চৌধুরী বলেন, ‘রেলের টিকিট কালোবাজারি রোধে আমি জিরো ট্রলারেন্স নীতিতে আছি। পুরো রমজানজুড়ে চট্টগ্রামসহ আমার আওতাধীন সবকটি স্টেশনে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হবে। কালোবাজারিতে কেউ টিকিট বিক্রি করছে এমন তথ্য পেলে অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। থানা পুলিশকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
চট্টগ্রাম রেল স্টেশনের প্রধান বুকিং সহকারী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কোনও বুকিং সহকারী অবৈধপন্থায় টিকিট দিচ্ছে কিনা তা আমার জানা নেই। তা জানা সম্ভবও নয়। আমাকে সারাদিন টাকার হিসাব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। কোনও বুকিং সহকারী টিকিট কালোবাজারিতে জড়িত; এমন অভিযোগ পেলে অবশ্যই কর্মকর্তাদের জানানো হবে।’