করোনার ধকল কাটিয়ে এবার সংগঠন গোছানোয় ব্যস্ত হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। গত দুই বছরের সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে মরিয়া দলটির নেতারা। এরই মধ্যে জেলা-উপজেলা সফর করে তৃণমূল চাঙা করছেন তারা। টার্গেট সারাদেশে দলের শাখা সম্মেলন শেষ করে ডিসেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান। একই সঙ্গে নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার করা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে দুর্বল হতে থাকে করোনাভাইরাস। স্বাভাবিক হতে থাকে জনজীবন। এরই মধ্যে সাংগঠনিক কাজে মনোনিবেশ করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। টিম এরই মধ্যে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সফর করছে। বেশ কিছু জেলায় সম্মেলন, বর্ধিত সভা ও কমিটি করা হয়েছে। কিছু জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের কোন্দল নিরসনে উভয়পক্ষের সঙ্গে কেন্দ্রীয় টিম বসে আলাপ-আলোচনা করেছে, নানা দিক নির্দেশনা দিয়ে শাখা সম্মেলন আয়োজনের তাগিদ দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তাদের টার্গেট স্বল্প সময়ের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ শাখাগুলোর সম্মেলন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা। এজন্য তারা তৃণমূলে সফর করছেন। যথাসময়ে সম্মেলন হবে এবং আওয়ামী লীগ নতুন নেতৃত্ব পাবে বলেও তাদের বিশ্বাস।
তবে তড়িঘড়ি করে কেন্দ্র থেকে কোথাও সম্মেলন, কোথাও বর্ধিত সভা বা সমাবেশ করে কমিটি গঠনের বিপক্ষে তৃণমূল। তারা বলছেন, ‘এগুলো তো সম্মেলন হচ্ছে না। সমাবেশ করে কমিটি দেওয়া হচ্ছে। নেতৃত্ব নির্বাচনে প্রাধান্য পাচ্ছে জেলা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নেতারা। তৃণমূলের কর্মীদের মতামত তো নেওয়া হচ্ছে না।’
তৃণমূলের নেতারা মনে করছেন, ‘এই প্রক্রিয়ায় ত্যাগীরা মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। দল ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে।’
গত কয়েকদিনের মধ্যে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সভা, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সভা, ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা, পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা, খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল প্রতিনিধি সভা ও বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভাসহ কিছু শাখায় কেন্দ্রীয় নেতাদের বিচরণ ছিল।
এরই মধ্যে সম্মেলন হয়েছে পঞ্চগড়, রাজবাড়ী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার। এছাড়াও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলা, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা, নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা, পঞ্চগড় সদর উপজেলা, গাজীপুরের শ্রীপুর, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, রাজশাহীর পবা, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার, জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল, কক্সবাজার পৌর শাখা, রাজশাহীর পুঠিয়া, কিশোরগঞ্জের নিকলী, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা, রাজশাহীর বাঘা, দিনাজপুরের হাকিমপুর ও চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলাসহ বেশ কিছু উপজেলা শাখার সম্মেলন হয়েছে।
আরও সম্মেলন হয়েছে বগুড়ার শেরপুরের বিশালপুর ইউনিয়ন, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়ন, রাজনগর ইউনিয়ন ও রাজশাহী জেলা দুর্গাপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের।
এছাড়াও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় বর্ধিত সভা, বরিশালের উজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, রাজশাহী মহানগর বোয়ালিয়া থানা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, সিলেট বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা, বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা ও হবিগঞ্জ চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা হয়েছে।
আসন্ন জাতীয় সম্মেলন ঘিরে আওয়ামী লীগের কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি টেবিলটকে উঠে আসছে নেতৃত্ব পরিবর্তনের বিষয়টি। আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে দীর্ঘদিন আছেন শেখ হাসিনা। তিনি প্রকাশ্যে বেশ কয়েকবারই নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ের জন্য নেতাকর্মীদের বলেছেন। তবে গত দুই সম্মেলনে নেতাকর্মীদের দাবির মুখে ফের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি।
সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়েও রয়েছে আলোচনা। টানা দুবার দায়িত্ব পালন করছেন ওবায়দুল কাদের। টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদক রাখার নজির আওয়ামী লীগে নেই। পাশাপাশি ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অবস্থাও বেশ খারাপ। যে কারণে কে হচ্ছেন নতুন সাধারণ সম্পাদক- এমন প্রশ্ন ক্ষমতাসীন দলের চায়ের টেবিলে কমন প্রশ্ন।
সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য আলোচনায় যারা
দলটির নেতাকর্মীদের আলোচনায় বেশ কয়েকটি নাম উঠে আসছে। তারা হলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ, ড. আব্দুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান। এছাড়াও টানা তিনবারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং বেশ কয়েকবার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মাহবুবউল আলম হানিফের নামও আসছে জোরালোভাবে। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও ড. হাছান মাহমুদও আছেন সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আলোচনায়।
তবে আওয়ামী লীগের রেওয়াজ হচ্ছে নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম প্রস্তাব করা হয় কাউন্সিলে। আর এটি হ্যাঁ/না ভোটে পাস হয়। যে কারণে প্রস্তাবনার ওপর নির্ভর করছে, কে হচ্ছেন আগামীর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এছাড়াও বেশ কয়েকটি পদে রদবদলসহ নতুন যুক্ত হবেন ৮-১০ জন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, আমাদের সম্মেলন সময়মতো হবে। আমরা সেজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এরই মধ্যে অনেক জেলায় সম্মেলন করেছি। ডিসেম্বর বা জানুয়ারির ভেতরেই আমরা দলীয় সম্মেলন করে সব সময়মতো শেষ করবো।
নেতৃত্বে পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব সময় সম্ভাবনা থাকে।’
এ নিয়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ একমাত্র রাজনৈতিক দল যার ভেতরে সবচেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক চর্চা হয়। এই দলে কথা বলা যায়। নেতাকর্মীদের মতপ্রকাশের অধিকারসমৃদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। এই দলটির কাউন্সিলও যথাসময়ে হয়, হবে। কাউন্সিলে কাউন্সিলররা আসবেন, সেখানে আলাপ-আলোচনা হবে। মতবিনিময় হবে। কাউন্সিলররা মতামত ব্যক্ত করবেন। কাউন্সিলরদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত হবেন।’
দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এখন তৃণমূল, উপজেলা, জেলা সম্মেলন নিয়ে কাজ করছি। আমাদের টার্গেট স্বল্প সময়ের মধ্যে সব পর্যায়ের মেয়াদোত্তীর্ণ সম্মেলন সম্পন্ন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন যেহেতু নিয়মিত হয়, নির্ধারিত সময়ে জাতীয় সম্মেলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, করোনা পরিস্থিতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।’
আসছে সম্মেলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের পরিবর্তন নিয়ে এই নেতা বলেন, ‘মূল নেতৃত্ব যেহেতু সর্বজনশ্রদ্ধেয়, সর্বজন আকাঙ্ক্ষিত এবং অপরিহার্য, সেহেতু বাকি পদগুলো পরিবর্তন বা ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকা সম্পর্কে এত আগে বলার মতো কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি।’
এ নিয়ে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী আজাদ জাহান শামীম বলেন, ‘তৃণমূলের কর্মী হিসেবে আমার জেলায় যা হচ্ছে তা কোনো সম্মেলন নয়। সমাবেশ করে কমিটি দেওয়া হচ্ছে। নেতৃত্ব নির্বাচনে ভূমিকা রাখছেন জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি। এতে তৃণমূল ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। নেতা নির্বাচনে পদবাণিজ্যেরও অভিযোগ উঠছে। দল ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে।’
৬৪টি জেলা ও ১২টি সিটি করপোরেশনসহ আওয়ামী লীগের মোট সাংগঠনিক জেলা কমিটি ৭৮টি। এসব জেলার আওতায় ৬২২টি উপজেলা কমিটি, ৫ হাজার ৬৪৩টি ইউনিয়ন কমিটি ও ৪৩ হাজার ৫৯৬টি ওয়ার্ড কমিটি রয়েছে।