মিনু আক্তার বলেন, কাওসার যেদিন গুম হন, সেদিন রাজধানীর নাখালপাড়া ও বসুন্ধরা থেকে আরও সাতজন নিখোঁজ হয়েছিলেন। তিনি বরিশালে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। স্বামীর খবর শুনে ঢাকায় আসেন, শুরু হয় র্যাব-পুলিশের কাছে ছোটাছুটি। এখন আর ধরনা দেন না।
মিনু আক্তার আরও বলেন, ‘মেয়ে আগে বাবার খোঁজ করলে বলতাম বিদেশে গেছে। এখন সব বোঝে। “মাঝে মধে৵ বলে, মা আমি পুলিশ হবো। আমি নিজেই বাবাকে খুঁজে বের করব।’”
প্রায় একই কথা বলেছে রেশমা আক্তার-মো. চঞ্চল দম্পতির ছেলে। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর শাহবাগ থেকে গুম হয়েছিলেন ছাত্রদল নেতা মো. চঞ্চল। তাঁদের একমাত্র ছেলের বয়স তখন তিন বছর। ওর ছেলেবেলাটা অন্যসব শিশুর মতো নয়।
‘এই যে ছোট ছোট বাচ্চারা বাবার জন্য কাঁদছে। এই চোখের কি পানির কোনো দাম নেই?’
জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমাবেশে অংশ নিতে যাওয়া রেশমা বলছিলেন, তাঁর স্বজনদের ছেলেরা বাবার হাত ধরে শুক্রবার নামাজ পড়তে যায়। তাঁর ছেলেকে যেতে হয় একা। তিনি ছেলেকে নিয়ে স্বজনদের সহযোগিতায় ঢাকা শহরে কোনো রকমে টিকে আছেন।
রেশমা আরও বলেন, কেউ কেন চঞ্চলকে খুঁজে বের করে দিচ্ছে না, একসময় এই প্রশ্ন করত ছেলে। এখন বড় হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
শিশুটির মতো বড় হওয়ার অপেক্ষায় আছে ঢাকার পল্লবী থেকে নিখোঁজ ছাত্রদল নেতা তরিকুল ইসলামের ছেলেও। তরিকুলের স্ত্রী বেবী আক্তার গতকাল সমাবেশের ফাঁকে বলেন, ১০ বছর আগে তাঁর স্বামী যখন গুম হন, তখন ছেলের বয়স ছিল ২২ মাস। বাবার জন্য কান্নাকাটি করত। এখন বুঝতে শিখেছে। সে বড় হয়ে ‘সরকারি কর্মকর্তা’ হতে চায়। তার বিশ্বাস, কেবল সরকারি কর্মকর্তা হলেই বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
গুম হয়ে থাকা বাবার সন্ধানে প্রায় ১০ বছর ধরে ‘মায়ের ডাক’–এর অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে বেশ কিছু শিশু। একসময় মায়ের কোলে চড়ে সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধনে আসত তারা। এখন বাবার ছবি বুকে সেঁটে রাস্তায় দাঁড়ায়। যারা সে সময় কিশোর ছিল, তাঁরা এখন তরুণ।
কুষ্টিয়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেনের ছেলে শেখ শাহেদ হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তিনি বলেন, সরকারকে জবাব দিতেই হবে। যত দিন না তিনি তাঁর বাবার খোঁজ পাচ্ছেন, তত দিন রাজপথ ছাড়বেন না। তাঁর দাদা একজন মুক্তিযোদ্ধা। পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। তারপরও তাঁর বাবার কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।
২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কাঠগড় এলাকা থেকে নিখোঁজ হন লক্ষ্মীপুর হাজিরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও থানা বিএনপির সাংগাঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুক। তাঁর ছেলে ইমন ওমর সমাবেশে অংশ নিতে ঢাকায় এসে বলেন, বাবা কেন নিখোঁজ তার জবাব চান তিনি। জবাব আদায় করেই ছাড়বেন।
ঢাকার মিরপুর থেকে ২০১৯ সালে গুম হওয়া কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেনের মেয়ে এখন কিশোরী। সে সমাবেশে বলে, দেশে নাকি কোনো গুম নেই। তাহলে কেন তার বাবাকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন কল্পনা চাকমা ও মাইকেল চাকমার সহযোদ্ধারা, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের গুম হয়ে থাকা নেতা এবং বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের গুম হওয়া নেতা-কর্মীদের স্বজনেরা। সমাবেশে উপস্থিত হয়ে সংহতি জানান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী প্রমুখ।
২০১০ সালের ২৫ জুন নিখোঁজ হওয়া ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের স্ত্রী হাসিনা চৌধুরী ও মেয়ে মাহফুজা আক্তারও ছিলেন সমাবেশে। মাহফুজা বলেন, এই যে ছোট বাচ্চারা বাবার জন্য কাঁদছে; এই চোখের পানির কি কোনো দাম নেই?