সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫

বিদেশে আশ্রয়প্রার্থীদের লক্ষ্য ইউরোপ, চান অ্যাসাইলাম

মাদারীপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ জাহিদ পেশায় উবারচালক। উবার চালিয়ে তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে ভালোই আছেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ইউরোপের কোনো দেশে পাড়ি জমানো। সুযোগ পেলে গাড়ি বিক্রির পাশাপাশি ধারদেনা করে হলেও ইউরোপ যাওয়ার নেশায় পেয়ে বসেছে জাহিদকে।

জাহিদের ভাষ্য, চোখের সামনে কতজনকে দেখেছি, জিরো থেকে হিরো হতে। এখানে (বাংলাদেশ) ১০ বছরে যা ইনকাম (আয়) হবে, ইতালিতে ঢুকতে পারলে সেটা তিন বছরে হয়ে যাবে।

ইউরোপে বিভিন্ন দেশের ২৯ লাখ অভিবাসী গত বছর আশ্রয়ের আবেদন করেছে, যা এর আগের বছরে তুলনায় শতকরা ৮৩ ভাগ বেড়েছে। এ তালিকায় আশ্রয় আবেদনের রেকর্ড গড়েছেন বাংলাদেশিরাও। এ সময়ে প্রায় ৩৯ হাজার বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয়ের আবেদন করেছে, যা গত বছরের তুলনায় শতকরা ৮৮ ভাগ বেশি। এসব আশ্রয়প্রার্থীর বেশিরভাগের লক্ষ্য ‘স্বপ্নের’ ইউরোপ।

২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবসকে সামনে রেখে সপ্তাহখানেক আগে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ফ্ল্যাগশিপ বার্ষিক প্রতিবেদন গ্লোবাল ট্রেন্ডস ইন ফোর্সড ডিসপ্লেসমেন্ট প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে ১৬২ দেশের অভিবাসীর আশ্রয়ের আবেদন তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৯ লাখ অভিবাসী আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। যা ২০২১ সালের সংখ্যার তুলনায় শতকরা ৮৩ ভাগ বেড়েছে। সংস্থাটি বলছে, গত বছর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ৪ লাখ ৫৪ হাজার অভিবাসী আশ্রয়ের আবেদন করেছের। যা ২০২১ সালের তুলনায় শতকরা ৭৮ ভাগ বেড়েছে।

এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আশ্রয়ের আবেদন করেছে আফগানিস্তান। দেশটির ২ লাখ ৮৫ হাজার নাগরিক ৮৭ আবেদন করেছেন। এর পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটির ৫৮ হাজার ২০০ জন আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। এ তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে পাকিস্তান। দেশটির ৪১ হাজার নাগরিক আবেদন করেছেন, যা ২০২১ সালের তুলনায় শতকরা ৬৯ ভাগ বেশি। আর গত বছর ৩৮ হাজার ৯০০ বাংলাদেশি এ আবেদনে সামিল হয়েছেন, যা ২০২১ সালের তালিকার চেয়ে শতকরা ৮৮ ভাগ বেশি। এছাড়া ২৯ হাজার ৬০০ ইরানি নাগরিক আশ্রয়ে আবেদন করেছেন।

ওয়ার্ল্ডডাটা ডট ইনফোর তথ্য বলছে, গত বছর ইউরোপে রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশি আশ্রয়ের আবেদন করেছে। বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের তালিকায় শীর্ষ স্থানে রয়েছে ইতালি। দেশটিতে সাড়ে ১৪ হাজারের বেশি বাংলাদেশি আশ্রয় আবেদন করেছে। সেই তালিকা থেকে শ’খানেকের আবেদন গ্রহণ করা দেশটি; বাকিদের প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশদের আবেদনের শীর্ষ দুই, তিন ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে-ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভূমধ্যসাগরের পাশাপাশি ইইউর সদস্য নয় এমন দেশগুলোতে প্রবেশ করে সেখান থেকে স্থলপথ কিংবা ভিন্ন কোনো উপায়ে কাঙ্ক্ষিত ইউরোপের দেশে পাড়ি জমায় বাংলাদেশিরা। এছাড়া লিবিয়া হয়ে ইতালি, স্পেন, গ্রিস ও মাল্টা যাওয়া থামছে না।

মূলত, মানবপাচারকারীরা লোকজনকে ইউরোপে যেতে স্বপ্ন ও প্রলোভন দেখাচ্ছেন। তাদের সহযোগিতায় লোকজন নানা পন্থায় ইউরোপ পাড়ি জমাচ্ছেন। আর কাঙ্ক্ষিত দেশে পৌঁছাতে পারলে সেখানে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন তারা। আবার অনেকে রাজনৈতিক কারণে তথা মামলা-হামলার কারণেও ইউরোপের দেশগুলো আশ্রয় প্রার্থনা বা অ্যাসাইলাম চান।

লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। তার সমর্থিত দল ক্ষমতায় না আসতে পারলে তিনি ইউরোপের কোনো দেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করার চিন্তা-ভাবনা করছেন। সাইফুল বলেন, দলের জন্য আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে গেলে অপজিট পার্টির টার্গেটে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। পুলিশের মামলাতো আছেই। অবস্থার পরিবর্তন না হলে পরিস্থিতি বুঝে ইউরোপের কোনো দেশে গিয়ে অ্যাসাইলাম চাইব।

প্রতি বছর বাংলাদেশিদের আশ্রয়প্রার্থিতা বাড়ার কারণ হিসেবে অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সি আর আবরার বলছেন, আমাদের দেশের অনেকর মধ্যে ইউরোপে পাড়ি জমানোর একটা প্রবণতা রয়েছে। সবাই ইউরোপ যেতে চায়। কিন্তু বৈধ পথে ইউরোপের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক অভিবাসনের সুযোগগুলো ক্রমশ কমে আসছে। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তাদের ডানপন্থি রাজনৈতিক কারণে অভিবাসনের মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলোতে লোকজন যাওয়ার সুযোগগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

অধ্যাপক আবরার বলেন, যেহেতু বৈধপথে চাকরি বা ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে তাই লোকজন সেটাকে অবৈধ উপায়ে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। তারা এটাও জানেন, কোনো কোনো দেশ কয়েক দিন পরপর সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করে। অনেক দেশ পরে তাদের অর্থনৈতিক চাহিদা বিবেচনায় তাদের অনেকে পাকাপোক্তভাবে বৈধতা দিয়ে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছেন। তারা ইউরোপ যাচ্ছেন এবং আবেদন করছেন শরণার্থী বলে। তারা আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন, দেশে তাদের জীবনের জন্য হুমকি রয়েছে। তাই তারা জীবনের ভয়ে দেশটিতে এসেছেন।

রাজনৈতিক আশ্রয় তথা অ্যাসাইলামের প্রসঙ্গ টেনে অভিবাসন ও উদ্বাস্তু এ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেভাবে চলছে এবং এখানে যারা ভিন্ন মতাবলম্বী বা অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্য তাদের নানা চাপে রাখা হয়। যার কারণে, তারা জেনুইনলি অ্যাসাইলাম চাইতে পারেন। তারা সেখানে যাচ্ছেন এবং রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করছেন। এটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। আমাদের এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারার সুযোগ দিনকে দিন কমে আসছে। যার ফলে তারা যেতেই পারেন। সেজন্য আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যাটা বাড়ছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছে, অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশিদের ইউরোপ যাত্রা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এসব অবৈধ অভিবাসীদের ফেরাতে নানা ধরনের চাপ অব্যাহত রেখেছে দেশগুলো। সে কারণে না চাইলেও অল্প অল্প করে ইইউর বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধদের দেশে ফেরাতে হচ্ছে।

অবৈধদের দেশে ফেরাতে ইইউর চাপ আছে। এ প্রসঙ্গে সরকারের করণীয় জানতে চাইলে সি আর আবরার বলেন, এটাতো থাকবে। আমরা সেই চাপ কতটুকু সহ্য করতে পারছি সেটাও দেখার বিষয়। আমাদের বলা দরকার, তোমরা বৈধ পথে অভিবাসনের সুযোগ করে দাও। এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা, শুধুমাত্র দক্ষ লোকের দরকার ইউরোপে; সেখানে অদক্ষ লোকেরও দরকার আছে। এ জায়গায় আমাদের দেন-দরবার করার সুযোগ রয়েছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশ্রয় আবেদন সংক্রান্ত সংস্থা ইইউএএ গত বছর ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থীর পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০ লাখ অভিবাসী ইইউর দেশগুলোতে আশ্রয় আবেদন করেছে। যা ২০১৬ সালের পর সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশি নাগরিকদের আশ্রয়প্রার্থীতা নিয়ে ইইউএএ বলছে, গত বছর প্রায় ৩৪ হাজার বাংলাদেশি ইইউ প্লাস (ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশ, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড) দেশগুলোতে আবেদন করেছে। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা শতকরা ৭০ ভাগ বেড়ে গেছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, যারা ইউরোপে অবৈধ উপায়ে যাচ্ছেন তাদের কিন্তু বিভিন্ন এজেন্টরা বিভিন্ন উপায়ে বুঝিয়ে রাজি করাচ্ছেন। প্রলোভন দেখাচ্ছেন। ইউরোপে বৈধভাবে থাকা বা কাজ করাটা খুব প্রতিযোগিতামূলক। সে কারণেও কিন্তু অনেকে অবৈধ উপায়ে যাবার চেষ্টা করছেন। আর অ্যাসাইলামের বিষয়টা অন্য। অনেকে হয়তো চিন্তা করে, আমি যদি অ্যাসাইলাম চাই তাহলে সুযোগটা ভালো পাওয়া যেতে পারে।

আসিফ মুনীর বলেন, সাধারণত যখন বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থা তৈরি হয় যেমন-নির্বাচন বা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে তখন অনেকে হয়তো মনে করে বিরোধী হলে তারা নিরাপদ না। এটা অনেক সময় হয়। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে দেখেছি, সম্প্রতি বিশেষ বাহিনীর হাতে অনেক সময় মানুষ নিগ্রহ হয় এবং বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও সেটা হচ্ছে; তবে এটার সংখ্যা খুব কম। আবার অনেকে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। এ প্রবণতা আগে থেকেই ছিল এখনও রয়ে গেছে। কেননা, অ্যাসাইলামের প্রক্রিয়াটা লম্বা সময়ে হয়। ততদিন তারা সেখানে থাকার সুযোগ পায়। সবকিছুর ধারাবাহিতায় হয়তো এ সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে।

Facebook
X
WhatsApp
Email
Telegram
সর্বশেষ
ফেসবুক নেটওয়ার্ক ও পার্টনার পেজ
মিডিয়া
Cover for Table Talk Uk
595,824
Table Talk Uk

Table Talk Uk

Table Talk UK Discusses the political and social issues of the country. Our only purpose is to expose social inconsistencies and politics in the face of accountability on the path to democracy and talk about the rights of people.

This message is only visible to admins.
Problem displaying Facebook posts. Backup cache in use.
PPCA Error: Due to Facebook API changes it is no longer possible to display a feed from a Facebook Page you are not an admin of. The Facebook feed below is not using a valid Access Token for this Facebook page and so has stopped updating.

Smash Balloon Custom Facebook Feed WordPress Plugin The Custom Facebook Feed plugin

সর্বশেষ সংবাদ জানতে—এখনই সাবস্ক্রাইব করুন!
সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
কপিরাইট © 2025 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত — লন্ডন মিরর।
সম্পাদক: হাসিনা আক্তার
সার্চ করুন
লগইন/সাইন আপ
সর্বশেষ সংবাদ জানতে—এখনই সাবস্ক্রাইব করুন!