মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের অধিকাংশকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছে দেশটির আপিল আদালত। স্থানীয় সময় শুক্রবার (২৯ আগস্ট) ওয়াশিংটন ডিসির ফেডারেল সার্কিটের জন্য মার্কিন আপিল আদালত এই রায় দিয়েছে। খবর রয়টার্সসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের।
ফেডারেল সার্কিটের জন্য মার্কিন আপিল আদালত ৭-৪ ভোটে রায় দিয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরোপিত ‘পারস্পরিক’ শুল্ক এবং চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর ফেব্রুয়ারিতে আরোপিত আলাদা শুল্কগুলো আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইনের (আইইইপিএ) অধীনে বৈধ নয়। এই আইন ১৯৭৭ সালে প্রণীত, জাতীয় জরুরি অবস্থায় ‘অস্বাভাবিক এবং অসাধারণ’ হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রপতিকে বিস্তৃত ক্ষমতা দেয়। কিন্তু এতে শুল্ক আরোপের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। আদালত বলেছে, মার্কিন সংবিধান কংগ্রেসকে শুল্ক ও কর আরোপের একচেটিয়া ক্ষমতা দেয় এবং রাষ্ট্রপতির কাছে এই ক্ষমতা হস্তান্তর স্পষ্ট এবং সীমিত হতে হবে।
ট্রাম্প এপ্রিলে ‘লিবারেশন ডে’ ঘোষণা করে বিশ্বের প্রায় সব বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর ‘পারস্পরিক’ শুল্ক আরোপ করেন, যা ১০ শতাংশ বেসলাইন থেকে শুরু করে ভারতের মতো দেশের জন্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়। তিনি দাবি করেন, দীর্ঘদিনের বাণিজ্য ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ক্ষমতা ও সামরিক প্রস্তুতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যা একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা। এছাড়া, ফেব্রুয়ারিতে চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর ‘ট্রাফিকিং শুল্ক’ আরোপ করা হয়, যা ট্রাম্প দাবি করেন ফেন্টানাইল মাদক পাচার রোধে প্রয়োজনীয়। যদিও এই দেশগুলো এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আদালত বলেছে, এই শুল্কগুলো ‘অসীমিত পরিসর, পরিমাণ এবং সময়কালের’ এবং আইইপিএর অধীনে অনুমোদিত নয়।
আদালত শুল্কগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করেনি, বরং ট্রাম্প প্রশাসনকে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার জন্য ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে শুল্কগুলো কার্যকর থাকবে। এই রায় ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর ট্রাম্পের অন্য শুল্কের উপর প্রভাব ফেলে না। কারণ সেগুলো ভিন্ন আইনি কর্তৃত্বের অধীনে আরোপিত।
ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এই রায়কে ‘অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে সমালোচনা করেছেন এবং দাবি করেছেন, সুপ্রিম কোর্টে আপিলের মাধ্যমে তিনি জয়ী হবেন। তিনি বলেছেন, এই শুল্কগুলো বাতিল হলে আমেরিকার জন্য এটি বিপর্যয় হবে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র কুশ দেশাইও বলেছেন, ট্রাম্প আইনি কংগ্রেসের দেওয়া শুল্ক ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন।
এই রায় দুটি মামলার ভিত্তিতে এসেছে: একটি পাঁচটি ছোট মার্কিন ব্যবসা এবং অপরটি ১২টি ডেমোক্র্যাটিক-নেতৃত্বাধীন মার্কিন রাজ্য দায়ের করেছিল। তারা যুক্তি দিয়েছে, আইইইপিএ শুল্ক আরোপের অনুমতি দেয় না এবং মার্কিন সংবিধান কংগ্রেসকে কর ও শুল্ক আরোপের একমাত্র ক্ষমতা দেয়। এর আগে, ২৮ মে নিউ ইয়র্কের মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালতও ট্রাম্পের শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল। বলেছিল যে, রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতা অতিক্রম করেছেন। এছাড়া, ক্যালিফোর্নিয়া সহ অন্তত আটটি মামলা ট্রাম্পের শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি তার দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন বৈদেশিক নীতির একটি মূল স্তম্ভ হয়ে উঠেছে, যা বাণিজ্যিক অংশীদারদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক ছাড় আদায়ে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে, এই শুল্কগুলো আর্থিক বাজারে অস্থিরতা বাড়িয়েছে এবং মার্কিন ব্যবসা ও ভোক্তাদের ওপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়েছে।
কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এই শুল্কগুলো মূল্যস্ফীতি বাড়াচ্ছে। রায়টি সুপ্রিম কোর্টে গেলে, ট্রাম্পের শুল্ক কৌশলের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আদালতের রায়ের ওপর, যেখানে ছয় জন রিপাবলিকান-নিযুক্ত বিচারপতি রয়েছেন। যার মধ্যে তিন জন ট্রাম্প নিজে নিয়োগ করেছেন। যদি শুল্কগুলো বাতিল হয়, তবে এটি ট্রাম্পের বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধে আলোচনার ক্ষমতাকে দুর্বল করতে পারে এবং আমদানিকারকদের জন্য বিলিয়ন ডলারের শুল্ক ফেরতের দাবি উঠতে পারে।
এই শুল্কগুলোর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থার অনুমোদন দিয়েছেন, যদিও তিনি আলোচনার ওপর জোর দিয়েছেন। কানাডায় ট্রাম্পের শুল্কের প্রতিবাদে বেশিরভাগ প্রদেশ মার্কিন মদের ওপর বয়কট ঘোষণা করেছে। যার ফলে ব্রাউন-ফোরম্যানের মতো কোম্পানির বিক্রি ৬০ শতাংশ কমে গেছে। ইউরোপীয় কমিশন মার্কিন শিল্প পণ্যের ওপর শুল্ক তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, যা মার্কিন গাড়ির উপর শুল্ক কমানোর পথ খুলতে পারে। এই রায় ট্রাম্পের শুল্ক কৌশলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে একটি বড় আইনি লড়াইয়ের পথ প্রশস্ত করেছে।


















