সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে গত বছরের ১ জুলাই থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে সংগঠিতভাবে নতুন এক ছাত্রআন্দোলনের সূচনা ঘটে। দিনটি ছিল দেশের অন্তত ১১টি স্থানে একযোগে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের একসঙ্গে রাজপথে নামার দিন। এর নেপথ্যে ছিল জুনজুড়ে চলা প্রস্তুতি ও পূর্বঘোষিত কর্মপরিকল্পনা।
সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী অবস্থান নেন। সেখান থেকে মিছিল বেরিয়ে কলাভবন, মল চত্বর, মাস্টারদা সূর্য সেন হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও বসুনিয়া তোরণ ঘুরে ফিরে আসে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে। পরে সেখানে অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ।
সমাবেশ থেকে ঘোষণা আসে—৪ জুলাইয়ের মধ্যে কোটা সংস্কার প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না এলে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম (বর্তমানে এনসিপির আহ্বায়ক) সমাবেশে বলেন, ‘৪ জুলাইয়ের মধ্যে আমাদের দাবি নিয়ে আইনিভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। আমাদের এমনভাবে আশ্বস্ত করতে হবে, যাতে কোটা সংস্কারের বিষয়টি নিষ্পত্তির দিকে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও হল বন্ধ করা যাবে না। প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে—শিক্ষার্থীরা যেন আবাসন, চিকিৎসা ও পাঠাগার সেবা থেকে বঞ্চিত না হন। আমরা প্রত্যয় স্কিমবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষকদের সঙ্গে একাত্মতা জানাই, কিন্তু এর নামে শিক্ষার্থীদের সুবিধা বন্ধ করা যাবে না।’ ২০২৪শের ১ জুলাই বাংলাদেশ এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়। এদিন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনাবিন্দু।
মানুষ কল্পনাও করেনি যে শুরুতে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
ছাত্রদের এই অসন্তোষের সূচনা ঘটে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করার রায়ের পর।
নাহিদ ইসলাম সেদিন পরবর্তী তিন দিনের আন্দোলনের ঘোষণাও দেন। ঘোষণামতো ২, ৩ ও ৪ জুলাই টানা তিনদিন শাহবাগ মোড় অবরোধ করে চলে মিছিল ও বিক্ষোভ।
একই দিনে ঢাকার বাইরেও কোটা সংস্কার দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের ঢেউ ওঠে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবরোধ করেন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পালন করেন মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি।
আন্দোলনকারীদের মূল দাবি ছিল—২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রেখে সরকার যদি পরবর্তীতে কোটাব্যবস্থা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তাহলে কমিশন গঠনের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করতে হবে।
এর আগে, ২০২৪ সালের ৫ জুন উচ্চ আদালত সরকারি দপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরাসরি নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এরপর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। রাষ্ট্রপক্ষ ৪ জুলাই আপিল বিভাগে সেই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করে, তবে সেদিন শুনানি হয়নি।
১ জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বাকের মজুমদার। বর্তমানে তিনি ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’-এর কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক। তিনি জানান, আমরা চেষ্টা করেছিলাম—একই সময়ে দেশের অন্তত ১১টি জায়গায় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে আন্দোলন নিশ্চিত করতে। আরও ছয়-সাতটি স্থানে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারেও কর্মসূচি পালিত হয়। এসব মিলিয়ে ১ জুলাই ছিল ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, ৫ জুন আদালতের রায়ের পর ৫ থেকে ৯ জুন পর্যন্ত আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করি। এরপর সরকারের সামনে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই সময় শেষ হলে ১ জুলাই থেকে সারাদেশে সংগঠিতভাবে আন্দোলন শুরু হয়।
এর আগে, ৯ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের একত্রিত করার কাজ চলেছে। তারই ফলাফল ১ জুলাইয়ের সমন্বিত কর্মসূচি।


















